Japan killed more than 30 thousand Chinese through Biological weapon in Unit-731 during World War II dgtl
Japan’s Unit-731
খেতে না দিয়ে জৈব অস্ত্র প্রয়োগ, হাজার হাজার নিরীহ চিনাকে খুন করেন জাপানি সেনাকর্তা, আমেরিকাকে তথ্য দিয়ে বেঁচে যান মূল চক্রী!
দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধ চলাকালীন জৈব অস্ত্র প্রয়োগে কয়েক হাজার চিনা নাগরিককে নৃশংস ভাবে খতম করে তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী জাপানি সেনা। এর জন্য ‘ইউনিট-৭৩১’ নামে একটি কেন্দ্র তৈরি করেছিল টোকিয়ো।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
এক দিকে সামুরাইদের হুঙ্কার। পাল্টা ড্রাগনের চোখরাঙানি। এই দু’য়ের জেরে ফের প্রশান্ত মহাসাগরের জলে উঠছে যুদ্ধের ঘূর্ণি। পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে দু’পক্ষের মুখোমুখি সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনেকেই। পাশাপাশি সামনে এসেছে আরও একটি প্রশ্ন। সম্ভাব্য সংঘর্ষে কি জৈবিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে যুযুধান দুই পক্ষ? ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে গোটা বিশ্বের কয়েক কোটি নিরীহ আমজনতা।
০২২০
চলতি বছরের নভেম্বরে সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপকে (পড়ুন তাইওয়ান) কেন্দ্র করে সুর চড়ায় চিন ও জাপান। সেই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই খবরের শিরোনামে এসেছে ‘ইউনিট-৭৩১’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-’৪৫ সাল) চলাকালীন এটি ছিল টোকিয়োর সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের জৈবিক মারণাস্ত্রের গবেষণাকেন্দ্র। সেখানে যন্ত্রণার চরম সীমায় নিয়ে গিয়ে যুদ্ধবন্দিদের তিলে তিলে খতম করার নৃশংস খেলায় মেতে থাকতেন সামুরাই জেনারেলরা। সেই আতঙ্ক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বেজিং।
০৩২০
জাপানি ভাষায় ‘ইউনিট-৭৩১’-কে বলা হত নানা-সান-ইচি-বুতাই। টোকিয়োর পুরনো নথিতে অবশ্য এর আরও তিনটি নাম পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি হল, মাঞ্চু ডিটাচমেন্ট-৭৩১, কামো ডিটাচমেন্ট এবং ইশি ডিটাচমেন্ট। ১৯৩৬ সালে উত্তর-পূর্ব চিনের হারবিনের পিংফাং জেলায় সংশ্লিষ্ট জৈবিক মারণাস্ত্রের গবেষণাকেন্দ্রটি গড়ে তোলেন তৎকালীন সামুরাই জেনারেলরা। ড্রাগনভূমির মূল ভূখণ্ড এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু জায়গায় ছড়িয়ে ছিল এর একাধিক শাখা।
০৪২০
গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকের গোড়ায় সামরিক শক্তির নিরিখে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে জাপান। ১৯৩১ সালে একটি সামরিক অভিযানে গোটা মাঞ্চুরিয়া কব্জা করে ফেলে টোকিয়ো। পরবর্তী পাঁচ বছর মূল চিনা ভূখণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি তাদের। প্রশাসনিক সুবিধার্থে সেখানে মাঞ্চুকুয়ো নামে একটি ‘পুতুল রাজ্য’ গড়ে তোলেন সামুরাই জেনারেলরা। হারবিনকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
০৫২০
‘ইউনিট-৭৩১’ তৈরির নেপথ্যে জাপানি সাম্রাজ্যবাদী ফৌজের মূল উদ্দেশ্য ছিল জৈবিক এবং রাসায়নিক হাতিয়ার নির্মাণ। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অচিরেই প্রাণঘাতী মানব-পরীক্ষায় জড়িয়ে পড়ে ওই প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রটি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন সার্জেন্ট জেনারেল (পড়ুন লেফটেন্যান্ট জেনারেল) শিরো ইশি। টোকিয়োর সামরিক শীর্ষকর্তাদের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। ওই সময় জৈবিক অস্ত্রের জন্য জলের মতো টাকা খরচে পিছপা হয়নি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র।
০৬২০
১৯২৫ সালের জেনেভা কনভেনশনে জৈবিক অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সাবধানবাণী অবশ্য কানেই তোলেনি জাপান। উল্টে মাঞ্চুরিয়া দখলের পর জৈবিক হাতিয়ারের গবেষণাকে আরও বেশি করে হাওয়া দিতে থাকে টোকিয়ো। সংশ্লিষ্ট মারণাস্ত্রটির শক্তি পরীক্ষার জন্য গিনিপিগ হিসাবে পরাধীন চিনা নাগরিকদের বেছে নেয় তারা। শুধু তা-ই নয়, জেনারেল শিরো ইশির নির্দেশে কয়েক হাজার মানুষকে প্রাণঘাতী ভাইরাস ও ব্যাক্টিরিয়ায় সংক্রমিত করা হয়েছিল।
০৭২০
জাপানি ফৌজের শীর্ষপদে থাকা শিরো ইশি আবার ছিলেন মাইক্রোবায়োলজ়ি বিশেষজ্ঞ এবং সামরিক চিকিৎসক। চিন-মাঞ্চুরিয়ায় মোতায়েন থাকা কোয়ান্টুং বাহিনীর গুপ্ত বিভাগ হিসাবে ‘ইউনিট-৭৩১’ গড়ে তোলেন তিনি। প্রথম দিকে সেখানে চলত মহামারি প্রতিরোধের গবেষণা। ধীরে ধীরে একে জৈবিক হাতিয়ারের নির্মাণকেন্দ্রে বদলে ফেলেন টোকিয়োর ক্ষুরধার মস্তিষ্কের সার্জেন্ট জেনারেল। তাঁর নেতৃত্বে কাজ করা গবেষকদের গোপন দলটির সাঙ্কেতিক নাম ছিল ‘টোগো ইউনিট’।
০৮২০
‘ইউনিট-৭৩১’ কাজ শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই ডিক্রি জারি করেন জাপানি সম্রাট হিরোহিতো। ফলে মহামারি প্রতিরোধ এবং জল পরিশোধনের নামে আনুষ্ঠানিক ভাবে জৈবিক হাতিয়ার তৈরি এবং তার প্রয়োগের অনুমতি পায় কোয়ান্টুং বাহিনী। এর পরই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন সার্জেন্ট জেনারেল ইশি। গবেষণাকেন্দ্রগুলির ভিতরে গজিয়ে ওঠে জেলখানা। সেখানে নিরীহ চিনাদের আটকে রেখে চলত জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ।
০৯২০
কোয়ান্টুং বাহিনীতে ইশির অন্যতম সমর্থক ছিলেন কর্নেল চিকাহিকো কোইজুমি। ১৯৪১-’৪৫ সাল পর্যন্ত জাপানের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। দ্বিতীয় ইপ্রেসের যুদ্ধে জার্মানদের ক্লোরিন গ্যাসের সফল ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হন চিকোহিকো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে মার্কিন বাহিনীর গোটা একটা ইউনিট ধ্বংস করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। ‘ইউনিট-৭৩১’কে কাজে লাগিয়ে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে শত্রুকে ঘায়েলের চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
১০২০
জৈবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণকেন্দ্রটিকে সফল করতে হারবিন রেলস্টেশনের ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ঝংমা দুর্গ তৈরি করেন সার্জেন্ট জেনারেল ইশি। প্রথম দিকে চোর, ডাকাত, খুনি-সহ অন্যান্য অপরাধীদের সেখানে আটকে রেখে জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরে অবশ্য এতে যুক্ত হয় রাজনৈতিক বন্দি এবং নিরীহ চিনা নাগরিক। গিনিপিগ হিসাবে গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য তাঁদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার করতে হাত কাঁপেনি টোকিয়োর ওই জেনারেলের।
১১২০
জাপানি ফৌজির নথি অনুযায়ী, ঝংমা দুর্গে বন্দিদের প্রথমে স্বাস্থ্যকর খাবার দেওয়া হত। এর মধ্যে থাকত ভাত, রুটি, মাংস, মাছ, এমনকি মদও। কিছু দিন পর হঠাৎ করেই খাবার পাঠানো বন্ধ করে দিতেন সার্জেন্ট জেনারেল ইশি। ওই সময় এক ফোঁটা জলও পেতেন না তাঁরা। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই বন্দিরা নিস্তেজ হয়ে পড়তেন। সেই সময় তাঁদের উপর প্রয়োগ করা হত জৈবিক অস্ত্র। অর্থাৎ, জোর করে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত কলেরা বা প্লেগের মতো মারণরোগের ব্যাক্টিরিয়া।
১২২০
১৯৩৫ সালে একটি বিস্ফোরণে ঝংমা দুর্গটি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইশি সেটি বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরে হারবিন থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে নতুন একটি ইউনিট স্থাপন করেন তিনি। ১৯৪১ সাল আসতে আসতে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির একাধিক শাখা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপানি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বেজিং, নানজিং, গুয়াংজ়ু, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স এবং সাবেক বর্মা মুলুকেও (বর্তমান মায়ানমার) ‘ইউনিট-৭৩১’-এর মতো কেন্দ্র গড়ে তোলে টোকিয়ো।
১৩২০
ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলিতে কাজ করতেন ১০ হাজারের বেশি কর্মী। তাঁদের বড় অংশই ছিলেন চিকিৎসক ও জৈব অস্ত্রের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানী। প্লেগ বা কলেরার মতো মহামারি ছড়ানো ব্যাক্টিরিয়াগুলির প্রতিষেধক তৈরিতেও তাঁদের কাজে লাগিয়েছিল তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদী জাপানি সরকার। কারণ জীবাণু-যুদ্ধে সম্পূর্ণ এশিয়া মহাদেশ কব্জা করার স্বপ্ন তত দিনে দেখতে শুরু করেছেন তাঁরা।
১৪২০
১৯৪০ সালের পর চিনা যুদ্ধবন্দিদের উপর বহুল পরিমাণে জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগ শুরু করে জাপানি ফৌজের কোয়ান্টুং বাহিনী। এ ছাড়া রুশ এবং কোরীয়দের উপরেও সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি ব্যবহার করা হয়েছিল। এর থেকে রেহাই পায়নি শিশু এবং গর্ভবতী মহিলারাও। জীবাণু-অস্ত্রে বেঁচে যাওয়া নাগরিকদের আবার পটাশিয়াম সায়ানাইডের মতো তীব্র বিষ প্রয়োগে হত্যার নিদর্শনও রয়েছে।
১৫২০
‘ইউনিট-৭৩১’-এ জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগে মোট কত জনের মৃত্যু হয়েছিল, তা কখনওই প্রকাশ করেনি জাপান সরকার। তবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলিতে আনুমানিক মৃতের সংখ্যা ছিল ১৪ হাজার। এ ছাড়া জীবাণু আক্রান্ত হয়ে চিনের গ্রাম এবং শহরতলিতে প্রাণ হারান আরও ২০ হাজারের বেশি নাগরিক। কোনও কোনও জায়গায় তো মড়ক লাগার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
১৬২০
গোদের উপর বিষফোড়ার মতো জীবাণু-অস্ত্র প্রয়োগের পর ড্রাগনভূমির সেই এলাকায় জল সরবরাহ বন্ধ করে দিত জাপানি সেনা। কৃষিজমিতে মিশিয়ে দেওয়া হত বিষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে গেলে ‘ইউনিট-৭৩১’-এর ১২ জন কর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে বিচার শুরু করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাঁদের প্রত্যেককেই কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
১৭২০
কিন্তু গোটা প্রকল্পের মূল মাথা ইশির কেউ টিকিটি পর্যন্ত ছুঁতে পারেননি। জৈবিক অস্ত্রের গবেষণালব্ধ তথ্য আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে যাবতীয় পাপ ধুয়ে ফেলেন তিনি। তাঁকে আড়াল করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান। ১৯৫৯ সালে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওয়াশিংটনের থেকে পেনশনও পেতেন তিনি।
১৮২০
২০০২ সালের ২৮ অগস্টে চিনে জৈবিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ স্বীকার করে টোকিয়োর একটি জেলা আদালত। তবে এর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও সামরিক কর্তাকে দায়ী করেনি তারা। উল্টো গোটাটাই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নেওয়া সরকারি সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বেজিং সুর চড়ালেও তাতে তেমন লাভ হয়নি।
১৯২০
৭ নভেম্বর সাবেক ফরমোজ়া তথা দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নিয়ে বিবৃতি দেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। সংশ্লিষ্ট দেশটিকে চিন কব্জা করতে চাইলে টোকিয়ো যে চুপ করে বসে থাকবে না, তা স্পষ্ট করে দেন তিনি। প্রয়োজনে তাইওয়ানকে সামরিক সাহায্যের কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। সামুরাই প্রধানমন্ত্রীর এ-হেন মন্তব্যের পরেই সুর চড়ায় বেজিং। উপকূলরক্ষী বাহিনীর রণতরীকে ঘিরে ফেলে জাপানের সেনকাকু দ্বীপ।
২০২০
বেজিঙের ওই শক্তি প্রদর্শনে চুপসে যায়নি জাপান। উল্টে একতরফা ভাবে বেজিং ‘অস্তিত্বের সঙ্কট’ তৈরি করছে বলে পাল্টা হুঙ্কার দিয়েছে টোকিয়ো। ফলে যে কোনও মুহূর্তে দু’তরফে সংঘর্ষ বাধার প্রবল আশঙ্কার কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। সেই সংঘাতে আরও এক বার যুযুধান দুই দেশ জীবাণুযুদ্ধের মুখোমুখি হবে কি না, আগামী দিনে মিলবে তার উত্তর।