পশ্চিমি বিশ্বের নিষেধাজ্ঞায় তেলের বাজার টলমল, চাপে পড়ে রুশ তেল আমদানি করা বন্ধ করল মুকেশের রিলায়্যান্স
রিলায়্যান্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রুশ তেলের মজুত শেষ হয়ে গেলে ১ ডিসেম্বর থেকে তারা আর রুশ তেল থেকে উৎপাদিত পেট্রোপণ্য রফতানি করবে না। এই বিষয়ে সংস্থার এক মুখপাত্র একটি বিবৃতি জারি করেছেন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫ ১৪:৪৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
মার্কিন চাপের মুখে পড়ে ইতিমধ্যেই রাশিয়া থেকে তেল কেনা কমিয়ে দিয়েছে ভারত। এ বার ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে দিল রিলায়্যান্স গোষ্ঠী। চলতি বছরের ২০ নভেম্বর রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ় লিমিটেড (আরআইএল) জানিয়েছে যে, তারা গুজরাতের জামনগরস্থিত শোধনাগারের জন্য রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আপাতত কিনবে না।
০২১৮
আরআইএলের শোধনাগারের দুটি ইউনিট রয়েছে। সেটির একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এসইজ়েডে অবস্থিত। সেখান থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত (ইইউ) একাধিক দেশ এবং আমেরিকায় পেট্রোপণ্য সরবরাহ করে ওই সংস্থাটি। কিন্তু সম্প্রতি রুশ তেলের উপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা জারি করায় বিপাকে পড়ে রিলায়্যান্স। এই পরিস্থিতিতে রফতানি বাণিজ্য ঠিক রাখতে আপাতত মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
০৩১৮
সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে রুশ তেলের মজুত শেষ হয়ে গেলে ১ ডিসেম্বর থেকে তারা আর রুশ তেল থেকে উৎপাদিত পেট্রোপণ্য রফতানি করবে না। এই বিষয়ে সংস্থার এক মুখপাত্র একটি বিবৃতি জারি করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে ২০ নভেম্বর থেকে আরআইএলের এসইজ়েড শোধনাগারে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
০৪১৮
যে কোনও বৃহৎ শোধনাগারে মজুত থাকে অতীতে কেনা কাঁচা তেল (অপরিশোধিত তেল)। এটি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের পেট্রোপণ্য। রিলায়্যান্সের মুখপাত্র জানিয়েছেন, বর্তমানে পুরনো মজুত থেকে রুশ তেল প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলছে। এটা শেষ হয়ে গেলে রফতানির জন্য আর রাশিয়ার থেকে ‘তরল সোনা’ কিনবে না তারা।
০৫১৮
চলতি বছরের অক্টোবরে রাশিয়ার বৃহত্তম দুই তেল উৎপাদনকারী সংস্থা রসনেফ্ট এবং লুকঅয়েলের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা। ২১ নভেম্বর থেকে রাশিয়ার তেল সংস্থা দু’টির উপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করছে ট্রাম্প সরকার। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শুরুর মুখেই রুশ সংস্থাগুলি থেকে আমদানিকৃত তেলের পেট্রোপণ্যের রফতানি বন্ধ করল রিলায়্যান্স।
০৬১৮
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি হলে কোনও সংস্থা এদের থেকে তেল কিনলে নিষেধাজ্ঞা চাপবে তাদের উপরেও। এর ফলে ভারতে সবচেয়ে চাপে পড়ল মুকেশ অম্বানীর রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়। পরিসংখ্যান বলছে, জানুয়ারি-জুনে রাশিয়া থেকে অর্ধেকের বেশি তেল কিনেছে রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়ই।
০৭১৮
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) হল রিলায়্যান্সের একটি বড় বাজার। এত দিন ওই গোষ্ঠীর একাধিক দেশে পরিশোধিত রুশ তেল বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করছিল মুকেশ অম্বানীর সংস্থা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে মস্কোর ‘তরল সোনা’ ও প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা ধীরে ধীরে বন্ধ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অক্টোবরে যা ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটির কাউন্সিল।
০৮১৮
ইউরোপীয় কাউন্সিল জানিয়েছে, ২০২৮ সালের ১ জানুয়ারির মধ্যে রাশিয়ার থেকে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা পুরোপুরি বন্ধ করবে তারা। কারণ এখানেও কলকাঠি নেড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে বার বার ইউরোপীয় দেশগুলিকে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। ট্রাম্পের দাবি, ইউরোপের দেশগুলি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করলেই একঘরে করা সম্ভব হবে পুতিনকে। আর তাতেই যুদ্ধের অবসান হবে। কারণ, জ্বালানি বিক্রির টাকাই নাকি মস্কো যুদ্ধের খরচ জোগাচ্ছে। ট্রাম্পের সতর্কবার্তাকে ইউরোপীয় জোট গুরুত্ব সহকারে দেখছে, তা বলাই বাহুল্য।
০৯১৮
সম্প্রতি, ইউরোপের লুক্সেমবার্গে বৈঠকে বসেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলির শক্তিসম্পদ মন্ত্রীরা। ওই বৈঠকে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি ধাপে ধাপে কমিয়ে এনে, ২০২৮ সালের মধ্যে তা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কী কারণে এই সিদ্ধান্ত তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে অনেকেই মনে করছেন, ইউরোপীয় জোটের এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে থাকতে পারে ট্রাম্পের চাপ।
১০১৮
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়েছে ভারতের বেসরকারি তেল আমদানিকারক সংস্থাগুলির উপর। কারণ ইউনিয়নের দেশগুলি নিজেরা তেল কেনা বন্ধ করার পাশাপাশি রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল থেকে উৎপাদিত জ্বালানি আমদানি ও বিক্রিকে সীমিত করার ব্যবস্থাও নিয়েছে। ইউরোপীয় বাজার যাতে হাতছাড়া না হয় তাই এই নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিলায়্যান্স। রফতানির জন্য এসইজ়েড শোধনাগারে ব্যবহৃত তেল রুশ সংস্থা ‘রসনেফ্ট’-এর কাছ থেকে আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিলায়্যান্স।
১১১৮
‘রসনেফ্ট’-এর সঙ্গে দিনে পাঁচ লক্ষ ব্যারেল (বছরে আড়াই কোটি টন) অপরিশোধিত তেল কেনার জন্য ২৫ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল রিলায়্যান্স। কিন্তু বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রুশ সংস্থাগুলিকে নতুন করে তেলের বরাত দিচ্ছে না তারা। মুকেশের সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের দাবি, এতে আমেরিকার বাজারে বিপুল লোকসানের মুখ দেখতে হতে পারে তাদের।
১২১৮
সূত্রের খবর, নিষিদ্ধ সংস্থাগুলির কাছ থেকে তেল কিনলে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে পারবে না রিলায়্যান্স। ক্রেমলিনের তেল পরিশোধন করে পেট্রোপণ্য ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে তাদের ঘাড়েও নিষেধাজ্ঞা চাপলে ব্যবসার পথও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই রাশিয়ার সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি ও বরাত বাতিলের পথেও অম্বানীর সংস্থা হাঁটতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৩১৮
রিলায়্যান্স জানিয়েছে, এ বছরের ১২ নভেম্বর রাশিয়া থেকে শেষ বার তেল আমদানি করা হয়েছিল। ২০ নভেম্বর বা তার পরে আসা যে কোনও রুশ জ্বালানি পণ্য শোধনাগারের অভ্যন্তরীণ শুল্ক এলাকায় (ডিটিএ) অবস্থিত ইউনিটটিতে গ্রহণ এবং প্রক্রিয়াজাত করা হবে। এসইজ়েড ইউনিটের অপরিশোধিত তেল আমদানি করার জন্য পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে সেখানে ডিসেম্বরের পর থেকে পণ্য তৈরির জন্য রুশ তেল ব্যবহার করা হবে না।
১৪১৮
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, রাশিয়ার সংস্থা দু’টির উপর নিষেধাজ্ঞা বসলেই সেখান থেকে তেল কেনা কমবে। এখন এ দেশে আমদানি হওয়া তেলের এক তৃতীয়াংশই রাশিয়ার। এ বছর দিনে গড়ে আমদানি হওয়া প্রায় ১৮ লক্ষ ব্যারেলের ১২ লক্ষই রসনেফ্ট ও লুকঅয়েলের। ওই দু’টি সংস্থার থেকেই বেশির ভাগ তেল কেনে দেশীয় তেল সংস্থাগুলি। জানুয়ারি-জুনে সে দেশ থেকে অর্ধেকের বেশি তেল কিনেছে রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়, এইচপিসিএল-মিত্তল এনার্জি, ম্যাঙ্গালোর রিফাইনারি অ্যান্ড পেট্রোকেম।
১৫১৮
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নিষেধাজ্ঞার আঁচ সবচেয়ে বেশি টের পাবে রিলায়্যান্স। দুই সংস্থার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিও রয়েছে। ফলে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এড়াতে গেলে তেল আমদানির জায়গা বদলাতে হবে তাদের।
১৬১৮
দিন কয়েক আগে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল আপাতত অশোধিত তেলের চাহিদা মেটাতে ভারতের প্রধান তেলশোধক সংস্থা ‘স্পট মার্কেট’ (যেখানে রফতানিকারক সংস্থা বা দেশের কাছ থেকে বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী দ্রুত তেল আমদানি করা যাবে) থেকে তেল আমদানি করছে। সূত্র উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ় আপাতত স্পট মার্কেট থেকেই তেল কেনার পরিমাণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৭১৮
তবে তেল পরিশোধনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার রাশিয়ার থেকে তেল কেনাবেচার পরিসংখ্যান কিন্তু ভিন্ন। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার এক রিপোর্ট বলছে, এখনও দেশে অপরিশোধিত তেলের সিংহভাগই আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। গত পাঁচ বছরে তা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। ২০২১-’২২ সালে ৪০ লক্ষ টন তেল কেনা হয়েছিল। গত অর্থবর্ষে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৮ কোটি টন।
১৮১৮
চলতি অর্থবর্ষে এপ্রিলের পর থেকে অগস্টের শেষ পর্যন্ত তেল কেনা হয়েছে ৪ কোটি টন। ফলে চলতি অর্থবর্ষে রাশিয়ার থেকে তেল আমদানি কমবে না, বরং আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞমহলের। শুধু অক্টোবরেই মস্কোর তেল কিনতে ২৫০ কোটি ইউরো (প্রায় ২৬,২৫০ কোটি টাকা) খরচ করেছে ভারত। উপদেষ্টা সিইআরএ-র দাবি, সেপ্টেম্বরে একই মূল্যের আমদানি হয়েছিল। তবে গত মাসে পরিমাণে ১১ শতাংশ বেশি কিনেছে দেশীয় সংস্থাগুলি। ফলে ভারত এখনও রুশ তেলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার।