US may paid big price for destroying relationship with India due to Donald Trump’s tariff policy dgtl
India US Conflict
চওড়া হচ্ছে দুই ‘কৌশলগত অংশীদার’-এর সম্পর্কের ফাটল! ভারতকে ‘খোয়ানো’র বড় মূল্য চোকাতে হবে আমেরিকাকে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির জন্য ভারত-আমেরিকার সম্পর্কে এসেছে শীতলতা। ধীরে ধীরে ওয়াশিংটনের থেকে দূরত্ব বাড়াচ্ছে নয়াদিল্লি। ভবিষ্যতে এর জন্য বড় মূল্য চোকাতে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রকে, বলছেন রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে গুপ্তচরবাহিনীর প্রাক্তন অফিসারেরাও।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৫ ১৩:০৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
রাজনীতিবিদ, সাবেক সেনাকর্তা থেকে শুরু করে গুপ্তচরবাহিনীর প্রাক্তন শীর্ষ আধিকারিক। এমনকি আমেরিকার এক জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের টানাপড়েনে একবাক্যে সকলেই দূষছেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ফাটল চওড়া হওয়ায় নয়াদিল্লি যে ভাবে চিনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে, তাতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনে আমেরিকাকে এর চরম মূল্য দিতে হতে পারে বলেও তাঁদের থেকে এসেছে সতর্কবার্তা।
০২২০
উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই বলা যেতে পারে নিকি হ্যালির কথা। চলতি বছরের ২০ অগস্ট ভারত-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘নিউজ়উইক’। সেখানে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রীতিমতো তোপ দাগেন তাঁরই দল রিপাবিকান পার্টির সদস্য নিকি। বলেন, ‘‘যাবতীয় সমস্যা মিটিয়ে নিতে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কথা বলা উচিত। কারণ, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে সেটা মেরামত করা কঠিন হবে।’’
০৩২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রথম দফায় ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন নিকি। গত বছরের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। যদিও অচিরেই দৌড় থেকে ছিটকে যান ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই আমেরিকান রাজনীতিবিদ। এর পর অবশ্য ট্রাম্পের জন্য প্রচারে যোগ দেন তিনি। এ-হেন নিকিও নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন।
০৪২০
রিপাবলিকান পার্টির সদস্য নিকি মনে করেন, বিশ্বের দু’টি বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত ও আমেরিকার মধ্যে কখনওই বিভেদ থাকা উচিত নয়। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রাম্প প্রশাসনের বিদেশনীতির একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত চিনের পরাজয়। কিন্তু বেজিঙের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। এটা বিপজ্জনক। এতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।’’
০৫২০
এর পাশাপাশি রাশিয়ার খনিজ তেল নিয়ে ট্রাম্পের দ্বিচারিতার দিকেও আঙুল তুলেছেন রিপাবলিকান পার্টির এই জনপ্রিয় নেত্রী। নিকি বলেছেন, ‘‘মস্কো থেকে তরল সোনা ভারতের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণে আমদানি করছে চিনও। বেজিংই বর্তমানে ওদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। অথচ প্রেসিডেন্ট ড্রাগন সরকারকে শুল্কের ক্ষেত্রে ৯০ দিনের ছাড় দিচ্ছেন। আর নয়াদিল্লিকে ক্রেমলিনের তেল কেনা বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।’’
০৬২০
‘নিউজ়উইক’কে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বার বার ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা ‘আধিপত্যবাদ’-এর প্রসঙ্গ তুলেছেন নিকি হ্যালি। তাঁর যুক্তি, ‘‘বেজিঙের মতো কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন একদলীয় অগণতান্ত্রিক একটি দেশকে বেশি সুবিধা দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। ফলে গত ২৫ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তা ধ্বংস হতে বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এটা কৌশলগত বিপর্যয়ের শামিল।’’
০৭২০
ভারত-মার্কিন সম্পর্কের অবনতিতে আরও কয়েকটি বিপদের উল্লেখ করেছেন নিকি হ্যালি। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যাবতীয় শিল্প উৎপাদন আমেরিকার ঘরের মাটিতে করতে চাইছেন ট্রাম্প। কিন্তু, তাঁর রিপাবলিকান সতীর্থ হ্যালি মনে করেন এটা রাতারাতি সম্ভব নয়। প্রেসিডেন্টের বেপরোয়া শুল্কনীতির জেরে ফল হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টে। মার্কিন উদ্যোগপতিরা আরও বেশি করে চিনমুখী হচ্ছেন।
০৮২০
‘নিউজ়উইক’কে হ্যালি বলেন, ‘‘এটা বুঝতে হবে যে ভারত এবং চিনের মাটিতেই একমাত্র সস্তায় পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। সেটা বস্ত্র, স্মার্টফোন বা সৌর প্যানেল— যা খুশি হতে পারে। গত কয়েক বছরে বেজিঙের উপর থেকে এই নির্ভরশীলতা আমরা কমাতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু যে ভাবে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে, তাতে শিল্পপতিদের পক্ষে ওয়াশিংটনের ভরসায় থাকা কঠিন। তাঁরা ফের বিপুল উৎপাদনের জন্য ড্রাগনভূমিতেই যাচ্ছেন।’’
০৯২০
উল্লেখ্য, ইজ়রায়েলের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোভুক্ত (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) দেশগুলিকে বাদ দিলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমেরিকার। সামরিক বিমান থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী ড্রোন, দূরপাল্লার কামান নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সমঝোতা ভাঙতে নারাজ নিকি হ্যালি।
১০২০
অন্য দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের শুল্ক নিয়ে ‘পাগলামি’র কড়া সমালোচনা করেছেন আমেরিকার সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) জন বোল্টন। ট্রাম্পের প্রথম কার্যকালের মেয়াদে ওই পদে ছিলেন তিনি। সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বোল্টন বলেছেন, ‘‘ভারতকে রাশিয়া ও চিনের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা দীর্ঘ দিন ধরে করা হয়েছে। সদ্য সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সাফল্য পেয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু জল ফের সম্পূর্ণ উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এর মূল্য চোকাতে হবে।’’
১১২০
নিকি ও বোল্টন ছাড়া ট্রাম্পের শুল্কনীতির কড়া সমালোচনা করেছেন জনপ্রিয় মার্কিন পপ সঙ্গীতশিল্পী মেরি মেলিবেন। সম্প্রতি এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘আমেরিকার ভারতকে প্রয়োজন। সত্যিকারের একজন বন্ধু হিসাবে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে কথা বলা উচিত ট্রাম্পের। আমার বিশ্বাস এতেই যাবতীয় জটিলতা কেটে যাবে।’’
১২২০
২০২৩ সালে প্রধানমমন্ত্রী মোদীর মার্কিন সফরের সময়ে একটি অনুষ্ঠানে তাঁর সামনেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন মেরি মেলিবেন। গান শেষ করে মোদীর পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদও নেন তিনি। গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁকে অবশ্য ট্রাম্পের হয়ে প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল।
১৩২০
গত জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে ২৭ অগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে এ দেশের সামগ্রীর উপরে ৫০ শতাংশ কর নেবে তাঁর প্রশাসন। এর জেরে আমেরিকায় ভারতীয় পণ্য বিক্রি করা কঠিন হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৪২০
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের বাণিজ্যিক উপদেষ্টা পিটার নাভারো আবার নয়াদিল্লিকে ‘শুল্কের মহারাজা’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘রুশ তেল কেনা ভারত বন্ধ না করলে অতিরিক্ত শুল্ক দিতেই হবে। ওদের সঙ্গে আমাদের বড় মাপের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এতে মার্কিন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মস্কোর ‘তরল সোনা’ আমাদের বিক্রি করে ওরা মুনাফা করছে।’’
১৫২০
ট্রাম্পের শুল্কনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নাভারো বলেছেন, ‘‘ভারতের রুশ তেলের কোনও প্রয়োজন নেই। ওরা মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ কিনে সেটা শোধন করে ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছে। এতে মুনাফা হচ্ছে নয়াদিল্লির। আর ভারতকে তেল সরবরাহ করে সেই পয়সায় ইউক্রেনের বাসিন্দাদের হত্যা করতে আরও অস্ত্র কিনছে ক্রেমলিন।’’
১৬২০
অন্য দিকে তিন দিনের মস্কো সফরে গিয়ে গত ২১ অগস্ট রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন জয়শঙ্কর। এ ছাড়া রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লেভরভের সঙ্গেও বৈঠক হয় তাঁর। পরে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে ক্রেমলিনের তেল আমদানির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করতে শোনা যায় বিদেশমন্ত্রীকে। ঠিক তখনই তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কোনও মাথামুন্ডু নেই।’’
১৭২০
রাশিয়ার থেকে ‘উরাল ক্রুড’ (মস্কোর অপরিশোধিত তেলের নাম) কেনার জন্য সম্প্রতি ভারতকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘বিশেষ কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে (পড়ুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট) কোনও মন্তব্য করব না। তবে এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রুশ তেল কিনি না। এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে রয়েছে চিন।’’
১৮২০
এর পরেই আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়াকে আয়না দেখান ভারতের বিদেশমন্ত্রী। বলেন, ‘‘আমরা রাশিয়ার থেকে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস বা এলএনজি) কিনছি না। সেটা সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কিনছে। ২০২২ সালের পর মস্কোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক লেনদেন সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়নি। আমি মনে করি সেই তালিকায় দক্ষিণের কিছু দেশ রয়েছে।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। এই দেশগুলির ক্ষেত্রে কেন খড়্গহস্ত হচ্ছে না ওয়াশিংটন?
১৯২০
পাশাপাশি, নয়াদিল্লিকে যে আমেরিকাই একটা সময়ে রাশিয়ার থেকে খনিজ তেল কিনতে বলেছিল, সংশ্লিষ্ট বৈঠকে তা-ও স্পষ্ট করেন জয়শঙ্কর। তাঁর কথায়, ‘‘গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম স্থির রাখতে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র। তার মধ্যে রাশিয়ার থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানিও ছিল। ঘটনাচক্রে আমরা ওয়াশিংটনের থেকে খনিজ তেল কিনে থাকি এবং সেটা বর্তমানে বৃদ্ধি করা হয়েছে। তার পরেও যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমরা বিভ্রান্ত।’’
২০২০
গত ১৫ অগস্ট পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ থামাতে আমেরিকার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। পরে সংঘাত বন্ধ করতে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে ফের এক বার রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করার আশ্বাস দেন তিনি। যদিও সেই অবস্থান থেকে বর্তমানে সরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ফলে নতুন করে নয়াদিল্লির উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ফিকির ওয়াশিংটন খুঁজছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই আবহে জয়শঙ্কর সুর চড়ানোয় তাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।