৭৮ বছর পর নিজের তৈরি ইউরোপের সামরিক জোট ভেঙে বেরিয়ে যাবে আমেরিকা? পশ্চিমি গণমাধ্যম রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে তার ইঙ্গিত মিলতেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:১৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
আর ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো নয়’। পরোপকারীর জামা খুলে রেখে এ বার ‘স্বার্থপর’ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! সেই লক্ষ্যে ইউরোপীয় সামরিক জোট নেটো ত্যাগের পরিকল্পনা করছেন খোদ আমেরিকার বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? শেষ পর্যন্ত তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিলে রাতারাতি পাল্টে যাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একাধিক অঙ্ক। শুধু তা-ই নয়, নেটো ভাঙলে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দেখবেন, তা বলাই বাহুল্য।
০২২০
চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটোর সম্পর্ক নিয়ে একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদসংস্থা রয়টার্স। সেখানে মার্কিন যুদ্ধ সদর দফতর পেন্টাগনের অন্তত পাঁচটি সূত্রের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট সংবাদসংস্থাটি জানিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে নেটো ত্যাগ করতে পারে আমেরিকা। কারণ, এই সামরিক জোটের অন্তর্গত ইউরোপীয় দেশগুলি তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে যে যে পদক্ষেপ করেছে, তাতে ওয়াশিংটন একেবারেই সন্তুষ্ট নয়।
০৩২০
বিষয়টি নিয়ে রয়টার্সের কাছে মুখ খুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেন্টাগনের একাধিক পদস্থ কর্তা। তাঁদের দাবি, ২০২৭ সালের মধ্যে নেটোর বেশির ভাগ সামরিক ঘাঁটি থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে আমেরিকা। সংশ্লিষ্ট জোটের নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং গোয়েন্দা তথ্য ইউরোপীয় দেশগুলিকে দিয়ে দেওয়া হবে। এর প্রস্তুতি কূটনৈতিক পর্যায়ে এখন থেকেই নিতে শুরু করেছে ওয়াশিংটন।
০৪২০
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি নেটো-ভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন পেন্টাগনের পদস্থ কর্তাদের একাংশ। সেখানেই সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটটির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দেন তাঁরা। সূত্রের খবর, আমেরিকার এ-হেন কঠোর অবস্থানকে ‘অযৌক্তিক’, ‘অবাস্তব’ এবং ‘মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করছেন নেটোর ইউরোপীয় সদস্যেরা। অন্য দিকে, ট্রাম্প সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন উদ্বিগ্ন মার্কিন রাজনীতিবিদদের একাংশও।
০৫২০
পশ্চিমি গণমাধ্যমটিকে পেন্টাগনের কর্তারা জানিয়েছেন, ২০২২ সালে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর থেকে দ্রুত বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। পরবর্তী পৌনে চার বছরে নেটোর ইউরোপীয় সদস্যেরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অত্যন্ত মজবুত করে তুলবে বলে মনে করেছিল ওয়াশিংটন। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। এই আবহে সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটটিতে থেকে পশ্চিম ইউরোপকে রক্ষা করার দায়িত্ব পুরোপুরি ভাবে নিজের কাঁধে রাখার ‘বোকামি’ করতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
০৬২০
‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) ঘনিষ্ঠদের দাবি, নেটোর সদস্যপদ থাকার কারণে সামরিক খাতে দিনকে দিন বাড়ছে খরচ। বর্তমান জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেই বোঝা বহন করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে আর সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নিলে ঘরের মাটিতে প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়তে পারেন ট্রাম্প। কারণ, আমেরিকার রাজনীতিবিদদের একাংশ তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত নন। প্রকাশ্যেই এর বিরোধিতা করছেন তাঁরা।
০৭২০
পেন্টাগন সূত্রে খবর, ট্রাম্পের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র নেটো ছাড়লে যাবতীয় অ-পারমাণবিক হাতিয়ার ইউরোপীয় সদস্য দেশগুলির হাতে তুলে দেবে ওয়াশিংটন। যদিও আমেরিকাকে ধরে রাখতে অন্য অংশীদারদের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কী কী সংস্কার বা পদক্ষেপ করতে হবে, তা স্পষ্ট নয়। তা ছাড়া ২০২৭ সালের সময়সীমাকে বাস্তবোচিত বলে মনেই করছেন না তাঁরা। আর তাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বদলের জন্য ক্রমাগত ট্রাম্পের উপর চাপ তৈরি করছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইটালির মতো রাষ্ট্র।
০৮২০
নেটোর ইউরোপীয় সদস্যদের অবশ্য দাবি, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরই প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে তারা। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির কোনও অভাব নেই। তার পরেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। এই জোটের অধিকাংশ দেশের সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণের পরিকাঠামো খুবই খারাপ। ফলে দ্রুত বড় সংখ্যায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, রণতরী, লড়াকু জেট বা অতি শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উৎপাদন করা খুবই কঠিন।
০৯২০
এই পরিস্থিতিতে নেটো-ভুক্ত দেশগুলিকে কেবলমাত্র আমেরিকার থেকে হাতিয়ার কেনার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। সেখানে আবার রয়েছে অন্য সমস্যা। সংশ্লিষ্ট সামরিক জোটের অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্রচুক্তি করলে, হাতিয়ার সরবরাহ করতে বছরের পর বছর সময় নেবে যাবতীয় মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা। কারণ, একসঙ্গে একাধিক দেশের জন্য বিপুল অস্ত্রের বরাত নেওয়ার সক্ষমতা নেই তাদের।
১০২০
তা ছাড়া জটিল ও অত্যাধুনিক হাতিয়ারের প্রতিরক্ষাচুক্তি কেবলমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল নয়। এর জন্য সবুজ সঙ্কেত দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’। অস্ত্রের ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গে দ্রুত সমঝোতার ব্যাপারে তা নেটোর ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, সংশ্লিষ্ট জোটের সব দেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সমান নয়। উদাহরণ হিসাবে ব্রিটেন এবং তুরস্কের কথা বলা যেতে পারে।
১১২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কথায়, ওয়াশিংটনের ভরসাযোগ্য মিত্রদের অন্যতম হল লন্ডন। অন্য দিকে নেটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও এই জোটেরই অন্যান্য অংশীদার, বিশেষত ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস ও ইটালির মতো রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক মোটেই মধুর নয়। আঙ্কারার সঙ্গে মস্কোর কূটনৈতিক সম্পর্কও বেশ ভাল। রাশিয়ার থেকে খনিজ তেল এবং এস-৪০০ ট্রায়াম্ফের মতো আকাশ প্রতিরক্ষা কিনেছে সাবেক অটোমান তুর্কিরা।
১২২০
সাবেক সেনাকর্তারা অবশ্য মনে করেন নেটো-ত্যাগের সময়ে মার্কিন ফৌজ যাবতীয় হাতিয়ার এবং গোয়েন্দা তথ্য ইউরোপের মাটিতে ফেলে এলে বেশ লাভবান হবে ওই জোটের সদস্য রাষ্ট্রেরা। সেগুলিকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কয়েক বছর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে তারা। এই আবহে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন নেটোর এক পদস্থ কর্তা। তিনি জানিয়েছেন, আমেরিকাকে ধরে রাখতে ইউরোপীয় মিত্ররা নিরাপত্তার জন্য আরও বেশি করে দায়িত্ব নিচ্ছেন।
১৩২০
তবে সংশ্লিষ্ট জোটটির অন্তর্গত ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো দেশগুলি মনে করে, তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ওয়াশিংটন থেকে ইউরোপে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। অন্য দিকে নেটো ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছেন পেন্টাগনের প্রেস সেক্রেটারি কিংসলে উইলসন। তিনি বলেছেন, ‘‘ইউরোপীয় মিত্রদের সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী করে তুলতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ যদিও ২০২৭ সালের সময়সীমা নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি।
১৪২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, নেটো অর্থাৎ ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন’-এর (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল আমেরিকাই। গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-’৪৫) শেষ হতে না হতেই কমিউনিস্ট শাসিত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। ওই সময় মস্কোকে ঘিরতে পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিকে নিয়ে এই সামরিক জোট গড়ে তোলেন ট্রাম্পের পূর্বসূরি হ্যারি এস ট্রুম্যান। সংস্থাটির জন্মের সালটা ছিল ১৯৪৯।
১৫২০
বর্তমানে নেটোর সদস্যসংখ্যা ৩২। সংশ্লিষ্ট সৈন্যচুক্তিটি ট্রাম্পের ‘বিষনজরে’ পড়ার নেপথ্যে সামরিক ব্যয়বরাদ্দকেই দায়ী করেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অভিযোগ, নেটো-ভুক্ত দেশের অধিকাংশই তাঁদের বৈদেশিক নিরাপত্তার বিষয়টি পুরোপুরি আমেরিকার উপর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে এতগুলি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত খরচের ভার বইতে হচ্ছে ওয়াশিংটনকে। ২০১৭-’২১ সাল পর্যন্ত প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন নেটোর সামনে একই শর্ত রেখেছিলেন তিনি।
১৬২০
২০২১ সালে ডেমোক্র্যাটিক নেতা জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে পরিস্থিতির বদল হয়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। ফলে পূর্ব ইউরোপে বেধে যায় যুদ্ধ। মস্কোর আগ্রাসনে ভয় পেয়ে নেটোয় যোগ দেয় সুইডেন ও ডেনমার্ক। এতে প্রতিরক্ষা খাতে আরও বৃদ্ধি পায় আমেরিকার আর্থিক বোঝা।
১৭২০
গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই ইস্যুকে সামনে রেখে প্রচারে ঝড় তোলেন ট্রাম্প। ভোটে জেতার পর ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘এনবিসি নিউজ়’-এর ক্রিস্টেন ওয়েলকারের সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আগামী চার বছরের কাজের রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি। সেখানেই প্রথম বার নেটো ছেড়ে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
১৮২০
‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, ‘‘যদি দেখি ওরা (চুক্তির অন্যান্য দেশ) যাবতীয় খরচের ভার ঠিকমতো বহন করছে, তা হলে নেটো ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সেটা না করলে ভাবতে হবে। শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে অবশ্যই আমি এই চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসব।’’
১৯২০
যদিও এ বছরের জুনে নেটোর বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট জোটটির সদস্যদের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের ব্যাপারে ভূয়সী প্রশংসা করেন ট্রাম্প। তখনই জানা যায়, সামরিক খাতে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস) অন্তত পাঁচ শতাংশ খরচ করছে এর অন্তর্ভুক্ত সমস্ত ইউরোপীয় রাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও যে ওয়াশিংটন খুশি নয়, ছ’মাসের মধ্যে সেই ‘হাঁড়ির খবর’ প্রকাশ্যে আনল রয়টার্স।
২০২০
এ-হেন নেটোর সদর দফতর বেলজ়িয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত। চুক্তিটিতে বলা রয়েছে, এর কোনও সদস্য রাষ্ট্র অপর কোনও দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে, সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র সামরিক দিক থেকে তাকে সাহায্য করতে দায়বদ্ধ থাকবে। বিশ্লেষকদের দাবি, এই সৈন্যচুক্তির ‘প্রাণভোমরা’ লুকিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজি ক্ষমতায়। সেই আমেরিকাই নেটো ছাড়লে রাতারাতি বদলে যাবে ইউরোপের শক্তির ভারসাম্য, যার সবচেয়ে বড় সুবিধা যে মস্কো পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।