Vladimir Putin plan to sell advertising space on Russian spacecraft and launch vehicles dgtl
Russia Advertising in Space
মহাশূন্যে এ বার তেল-শ্যাম্পু-সাবানের বিজ্ঞাপন! আইপিএলের কায়দায় স্পনসরশিপে উপগ্রহ ছাড়বেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন
মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এর আর্থিক সঙ্কট মেটাতে এ বার বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে এ বার থেকে তেল-শ্যাম্পু-সাবানের মতো বাণিজ্যিক সংস্থার লোগো গায়ে সেঁটে মহাশূন্যের পথে যাত্রা করবে মস্কোর যাবতীয় রকেট ও কৃত্রিম উপগ্রহ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৫২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
পাতালরেলের কামরা থেকে শহরের ব্যস্ততম বাস স্টপ। দিল্লি-কলকাতা-চেন্নাই হোক বা লন্ডন-প্যারিস-ওয়াশিংটন ডিসি। দুনিয়ার যাবতীয় জনবহুল জায়গাগুলির ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। কিন্তু তাই বলে মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহ! সেখানেও তেল-সাবান-শ্যাম্পুর গুণকীর্তন! শুনতে অবাক লাগলেও টাকা রোজগার করতে এ বার সেই রাস্তাই ধরছে রাশিয়া। মস্কোর এ-হেন সিদ্ধান্তে হতবাক বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহল।
০২১৮
১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। প্রথম দেশ হিসাবে মহাশূন্যে নভশ্চর পাঠিয়ে বিরল রেকর্ড করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। স্পেসস্যুট গায়ে চাপিয়ে পৃথিবীর বাইরে পা রাখা প্রথম ব্যক্তি ছিলেন ইউরি গ্যাগারিন। মস্কোর এই সাফল্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল। কিন্তু, সে সবই এখন অতীত। কারণ, বর্তমানে মারাত্মক আর্থিক সঙ্কটে ভুগছে রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’। আর তাই একরকম বাধ্য হয়েই নজিরবিহীন পদক্ষেপ করেছে ক্রেমলিন।
০৩১৮
রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এর চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথমই রয়েছে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়া। এর জেরে সার্বিক ভাবে মস্কোর আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ক্রেমলিনের দীর্ঘ সময় লেগেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও আর কখনওই সোভিয়েত জমানার মতো মহাকাশ গবেষণার জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করতে পারেনি পূর্ব ইউরোপের এককালের ‘সুপার পাওয়ার’।
০৪১৮
দ্বিতীয় সমস্যার জায়গাটি হল, ২০২২ সাল থেকে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে লড়াই শুরু হতে না হতেই মস্কোর উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে ব্যয়বহুল মহাকাশ কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও আন্তর্জাতিক অংশীদার গত পৌনে চার বছরে পায়নি রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে মহাকাশযানের গায়ে বিজ্ঞাপন সাঁটানোর সবুজ সঙ্কেতকে ক্রেমলিনের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
০৫১৮
‘রসকসমস’কে বাঁচানোর এই পরিকল্পনাটি পুরোপুরি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মস্তিষ্কপ্রসূত বলে দাবি করেছে একাধিক পশ্চিমি গণমাধ্যম। গোড়ায় অবশ্য সংস্থাটির বেসরকারিকরণের কথা চিন্তাভাবনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু, একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয় তাঁকে। যদিও প্রতিযোগিতামূলক মহাকাশের দৌড় থেকে সরে আসা মস্কোর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই বিজ্ঞাপনে লক্ষ্মীলাভকেই আপাতত পাখির চোখ করছে ক্রেমলিন।
০৬১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, পুতিনের সিদ্ধান্তে রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এ আসবে বড় বদল। এর ফলে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে কর্পোরেট স্পনসরশিপ টানার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে ক্রেমলিন। মস্কোর দাবি, আগামী দিনে সেই টাকাতেই মহাশূন্যে নভশ্চর বা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাবে তারা। আর এ ভাবেই পরিবর্তিত জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জ্যোতির্বিজ্ঞান কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে পূর্ব ইউরোপের এই দেশ।
০৭১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পুতিনের মস্তিষ্কপ্রসূত কর্পোরেট স্পনসরশিপের সঙ্গে অনেকেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড পরিচালিত আইপিএলের তুলনা টেনেছেন। সেখানে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে মোটেই বিপুল টাকা রোজগার করছে না বিসিসিআই। তাদের মুনাফার সিংহভাগ আসছে টিভির স্বত্ব এবং স্পনসরশিপ থেকে। বিনিময়ে খেলোয়াড় ও আম্পায়ারদের জার্সি থেকে ক্রিকেট কিটে সাঁটা থাকছে বিভিন্ন সংস্থার লোগো। এমনকি ট্রফির আগেও কর্পোরেট কোম্পানির নাম ব্যবহার করছে বোর্ড।
০৮১৮
সূত্রের খবর, ঠিক এই পদ্ধতি ‘রসকসমস’ পরিচালিত মিশনগুলিতে ব্যবহার করতে চাইছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ২০২১ সালে বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে উৎক্ষেপণ হওয়া সয়ুজ় রকেটে তার নমুনা দেখা গিয়েছিল। ওই সময় মহাকাশে রওনা হওয়া যানটির গায়ে সাঁটা হয় ‘পিৎজ়া হাট’-এর লোগো ও বিজ্ঞাপন। আগামী দিনে এই ঘটনা আরও বাড়বে বলে জানা গিয়েছে। ২০২২ সালে নিষেধাজ্ঞার জেরে মস্কোর জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা এবং ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
০৯১৮
‘রসকসমস’-এর জন্য কর্পোরেট স্পনসর জোগাড় করতে ইতিমধ্যেই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ক্রেমলিন। সেখানে বলা হয়েছে, রকেট, মহাকাশযান এবং কৃত্রিম উপগ্রহের গায়ে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে যে কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা। কোথায় এবং কতটা জায়গা জুড়ে প্রচারমূলক পোস্টার সাঁটা হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করবে বিজ্ঞাপনের খরচ। তবে সামরিক এবং গুপ্তচর উপগ্রহগুলিকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
১০১৮
সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ প্রকল্পগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএসে (ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন) যাতায়াতকারী সয়ুজ় ক্রু মডিউল। এতে বিজ্ঞাপন দিতে হলে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে বেশি টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞানের জটিল মিশনের কথা বলেও টাকা তোলার পরিকল্পনা করছে ‘রসকসমস’। যদিও তার রূপরেখা পুরোপুরি ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছে রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।
১১১৮
মহাকাশ বাণিজ্যের পরিকল্পনা রাশিয়ার কাছে একেবারেই নতুন নয়। এর আগে পৃথিবীর কক্ষপথ ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মস্কো। তার জন্য ১৯৯৯ সালে মহাশূন্যে বিশেষ ধরনের একটি বৃহৎ আয়না স্থাপনের চেষ্টা করে ‘রসকসমস’। তাদের ওই মিশনের পোশাকি নাম ছিল ‘জ়ানামইয়া ২.৫ মিশন’। সংশ্লিষ্ট আয়নাটিতে প্রতিফলিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তায় পৃথিবীতে পৌঁছোত সূর্যালোক। সেই অনুযায়ী এর নকশাও তৈরি করে ফেলেছিলেন ক্রেমলিনের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
১২১৮
কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় রাশিয়ার ওই মিশন। পরবর্তী সময়ে মহাশূন্যে আয়না বসানোর পরিকল্পনা পুরোপুরি বাতিল করেন মস্কোর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে সেখান থেকে সরে আসতে হয় তাঁদের। সংশ্লিষ্ট আয়নাটির জেরে দূষণ ছড়াবে বলে ওই সময়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া পৃথিবীর কক্ষপথের একাংশ পাকাপাকি ভাবে ক্রেমলিনের দখলে থাকবে, তা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব।
১৩১৮
ভারত, আমেরিকা, জাপান বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত দেশগুলির মহাকাশ গবেষণায় দীর্ঘ দিন আগেই পা রেখেছে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এ ব্যাপারে একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্থা ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা নাসা তো বর্তমানে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর দায়িত্ব পুরোপুরি ভাবে তুলে দিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হাতে।
১৪১৮
যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্কের সংস্থা ‘স্পেসএক্স’-এর নিজস্ব উৎক্ষেপণ কেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকেই টেলিযোগাযোগের একগুচ্ছ কৃত্রিম উপগ্রহকে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠিয়ে থাকে তারা। এর মাধ্যমে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি ইন্টারনেট পরিষেবা বিলি করছেন মাস্ক। গ্রাহকদের কাছে তা ‘স্টারলিঙ্ক’-এর ইন্টারনেট নামে পরিচিত।
১৫১৮
এ ছাড়া মহাকাশ ভ্রমণের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ‘স্পেসএক্স’-এর নাম। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পর্যন্ত নভশ্চরদের নিয়ে যাওয়ার বিশেষ মডিউল যান নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণ করে থাকে মাস্কের এই সংস্থা। কিছু দিন আগে সেখানে গিয়ে আটকে পড়েন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়াম। পরে ‘স্পেসএক্স’-এর মডিউলার যানেই নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন তিনি।
১৬১৮
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন’ বা ইসরো অবশ্য এতটা বেসরকারিকরণের পথে হাঁটেনি। তবে কৃত্রিম উপগ্রহ বা রকেট নির্মাণে বেসরকারি সংস্থার সাহায্য নিচ্ছে তারাও। আগামী দিনে মহাশূন্যে মানব মিশন পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসরোর। ফলে এ দেশেও মহাকাশ ভ্রমণ খুব দ্রুত শুরু হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৭১৮
কিন্তু, তার পরেও পুতিনের পরিকল্পনা কতটা সাফল্য পাবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। তাঁদের যুক্তি, মহাকাশ গবেষণা কোনও আইপিএল খেলা নয়। আর তাই কক্ষপক্ষে ঘুরতে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহের গায়ে সাঁটা সংস্থার লোগো কখনওই দেখতে পাবে না আমজনতা। এই অবস্থায় বিজ্ঞাপনদাতারা এ ব্যাপারে কতটা আগ্রহী হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই।
১৮১৮
তা ছাড়া স্পনসরশিপের মাধ্যমে টাকা তুলতে গিয়ে আইনি জটিলতার মুখে পড়তে পারে ‘রসকসমস’। ১৯৬৭ সালে স্বাক্ষরিত বহিঃমহাকাশ চুক্তিতে জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থাগুলিকে বেশ কিছু নিয়ম মানার কথা বলা হয়েছিল। তার মধ্যে অন্যতম হল মহাকাশ গবেষণাকে সব সময় মানবকল্যাণের কাজে লাগাতে হবে। সেখানে আর্থিক মুনাফার দিকে নজর দিতে পারবে না কোনও দেশ। আর তাই রকেটের গায়ে ‘পিৎজ়া হাট’-এর লোগো সাঁটা থাকলে জবাবদিহি করতে হতে পারে রাশিয়াকে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।