Advertisement
০২ মে ২০২৪
Humanity

হৃদয় যখন তৃষায় হানে

এই বিস্তৃত মরুসময়ে এই ট্যাক্সিটুকু আমাদের একমাত্র মরূদ্যান। ওতে চড়ে হয়তো এক দিন আমরা এক নতুন তৃণভূমিতে পৌঁছব জীবনের সমস্ত সতেজতা নিয়ে।

An image of drinking water

পড়ে রইল কেবল এক রোদে পোড়া ট্যাক্সি। সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার তৃষ্ণার্ত পথশিশুর মুখে জল ঢেলে দিচ্ছেন তাঁর নিজের জলের বোতল থেকে। ফাইল ছবি।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৩ ০৪:৩০
Share: Save:

বহুতলের নীচে গ্যারাজ। কোথাও খালি, কোথাও বা প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দশলাখি, কুড়িলাখি চারচাকা। তারই মধ্যে চোরের মতো ঘুরছিলেন মহিলা। এক হাতে ছোট্ট একটি প্যাকেটে খানিক মাছভাত। একটু আগে লিফ্ট থেকে নামতেই বেড়ালটা পায়ের কাছে মাথা নুইয়ে ‘ম্যাও’ ডাকছিল। ওর খিদে পেয়েছিল। জ্বলেপুড়ে যাওয়া দুপুরে বাড়িহীন পাড়ার ফ্ল্যাটঘেরা পথে ওর জন্য সামান্যতম খাদ্যকণাও পড়ে নেই। কমলা-সবুজ বালতিতে উচ্ছিষ্টরা এখানে পরিবেশরক্ষার্থে চালান হয়ে যায় সকাল বিকেল। পাড়ার কুকুর-বেড়ালের জন্য কিচ্ছু পড়ে থাকে না। মহিলা প্রাণপণ প্যাকেটটা লুকোচ্ছিলেন। পাছে ক্লোজ় সার্কিট ক্যামেরায় তাঁর ‘অপচেষ্টা’ ধরা পড়ে যায়। বহুতলে অনাকাঙ্ক্ষিত চতুষ্পদকে খাবার দিলে গ্যারাজ নোংরা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ, এই কংক্রিট রাজ্যের খোপে খোপে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের এক সময় হয়তো নিজেদের একটা বাড়ি ছিল। খাওয়া সেরে কর্তা বা গিন্নি সদরের পাশে সামান্য ভাত-রুটি নিয়ে হাজির হতেন নিয়ম করে। পাড়ার নেড়ি, হুলো, কাক, শালিক এমনকি শিং বাগিয়ে একটা গরু পর্যন্ত তার প্রাত্যহিক পাওনা বুঝে নিতে অপেক্ষায় থাকত সেখানে। ওরাও তো পরিবারেই ছিল! বেড়ালটা গেল কোথায়? বিফল-মনোরথ হয়ে লিফ্টে ওঠার সময় তাঁর চোখ পড়ল প্রৌঢ় নিরাপত্তারক্ষীর উপর। একটা ভাঙা টেবিল ফ্যান আর লোহার চেয়ার সম্বল করে কোনও মতে টিকে আছেন সিঁড়ির নীচে। দরদর করে ঘামছেন। এক বার ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল এনে দিয়েছিলেন। মিটিং-এ ‘আশকারা’র অভিযোগ ওঠার পর আর সাহস পাননি। লিফ্টের বোতাম টেপেন মহিলা। নিরাপত্তারক্ষী, ক্ষুধার্ত কুকুর-বেড়াল, গেট দিয়ে না ঢুকতে পারা ফেরিওয়ালা বা ভিখারি, অতীতে হারিয়ে যাওয়া বাড়ির পাঁচিলে রাখা জলের বাটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে দেওয়া তৃষ্ণার্ত কাকেদের থেকে পালিয়ে যেতে হবে তাঁকে। এক বার নিজের আকাশ-খোপে ঢুকে পড়লেই এই সব তিক্ততার মুখের উপর দরজা এঁটে দেওয়া যাবে। বাইরে ‘প্রখর তপন তাপে’ বায়ু যতই হাহাকার করুক, সূর্য ‘দারুণ অগ্নিবাণ’ হানুক, ঠান্ডা দুধে ফেলা তরমুজের শরবতে সে সব গলা দিয়ে নেমে যায়।

প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় খাঁ-খাঁ শূন্যতা। তবু কী আশ্চর্য, অর্ধনগ্ন শীর্ণকায় কয়েকটি শিশু ঘাস উঠে যাওয়া মাঠে মধ্যাহ্নের এই নিদারুণ ক্যানভাসেও দাপিয়ে খেলছে। ওদের কি খাওয়া হয়েছে? ওরা তো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে? ওদের বাড়িতে কেউ নেই? না কি সেই বাড়ির লোকজনও গ্রাসাচ্ছাদনের প্রবল তাড়নায় এই অগ্নিকুণ্ড মাথায় নিয়ে পথে পথে ঘুরছেন? সকালে সাত-বাড়ি কাজ সেরে গলির মোড়ে বসে গাছের ছায়ার একটু জিরিয়ে নিয়ে যে মহিলা আবার বিকেলের সাত-বাড়ির জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তিনি কি ওদের কেউ? জীবনবিমার যে জীবন্মৃত এজেন্ট এইমাত্র কোটা পূরণ না করতে পেরে অফিস থেকে বরখাস্ত হলেন অথবা সস্তা ফিনাইলের একটি বোতলও বেচতে না পারা যে তরুণী ক্লান্ত হয়ে পার্কের তপ্ত বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দিয়েছেন, বাচ্চাগুলোর সঙ্গে তিনিও হয়তো সন্ধে হলে একই ঘরে ফিরবেন। কিংবা হয়তো অনেকের ফেরার জন্য তেমন কোনও ঘরও থাকবে না। সন্ধে না পড়তেই টোকো পান্তা পেটে চালান করে ফুটপাতে চিত হয়ে শুয়ে তাঁরা গোটা আকাশ চারণ করবেন। এই গ্রীষ্মেও কিছুতেই বৃষ্টি চাইবেন না।

ফুটপাতের দোকানে ঠান্ডা ঘুগনির সঙ্গে গরম পাউরুটি দিয়ে ‘লাঞ্চ’ সেরে বেসরকারি সংস্থার তরুণ কর্মী আরাম করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়েন। বন্ধুদের সঙ্গে এই সিগারেট যাপন তাঁর একমাত্র রাজকীয় বিলাসিতা। কাল চাকরি থাকবে কি না জানা নেই। একটু পরেই বসের দ্বারা কতখানি অপমানিত হতে হবে, আশঙ্কা আছে। প্রেমিকাকে নিয়ে এই গরমে কোথায় যাওয়া যায় সন্ধেবেলা? শপিং মল, সিনেমা— এ সব তো গলাকাটা জায়গা। মাসের মাঝখানেই পকেট ভোঁ-ভাঁ। টাই-টা টাইট করে নেন তরুণ। ভিতরের ছেঁড়া গেঞ্জি ঘামে জবজব করছে। তবু একটু পরেই ঢুকতে হবে কর্মস্থলে। সিগারেটে লম্বা একটা টান দেন তিনি, ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর জেনেও। আসলে সময়ের স্বাস্থ্য ইদানীং বড্ড খারাপ যাচ্ছে। সেই রসহীন দীর্ঘ, তপ্ত যাপনে আবার লু বইছে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে। কিন্তু এই শুষ্কতা কি কেবলই নিসর্গের নৈরাজ্য? আমাদের হৃদয়ের অন্তঃসলিলা কি অনেক দিন ধরেই একটু একটু শুকিয়ে যাচ্ছিল না? ভালবাসা, সহমর্মিতা, সমানুভূতি নামক স্রোতগুলি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে কোথায় যেন হারিয়েই গেল। পড়ে রইল কেবল এক রোদে পোড়া ট্যাক্সি। সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার তৃষ্ণার্ত পথশিশুর মুখে জল ঢেলে দিচ্ছেন তাঁর নিজের জলের বোতল থেকে। এই বিস্তৃত মরুসময়ে এই ট্যাক্সিটুকু আমাদের একমাত্র মরূদ্যান। ওতে চড়ে হয়তো এক দিন আমরা এক নতুন তৃণভূমিতে পৌঁছব জীবনের সমস্ত সতেজতা নিয়ে। মাঝখানের এই শুকিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো পার হয়ে যাওয়া বড় কঠিন। রেকর্ড ভাঙা তাপপ্রবাহ আমাদের ঝলসে দিচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

humanity hot temperature summer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE