Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

০৮ মে ২০২৪ ই-পেপার

আরণ্যক জীবনের স্বাদ পেতে কলকাতা থেকে আসুন ঘন সবুজ পান্নায় কর্ণাবতীর তীরে

বর্ষায় এর ঘন সবুজ রং হার মানাবে যে কোনও খনির দুর্মূল্য পান্নাকে। তবে যদি জঙ্গল ভাল ভাবে উপভোগ করতে চান, আপনাকে যেতে হবে শীত অথবা বসন্তে।

অর্পিতা রায়চৌধুরী
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:৫৫

পান্না জাতীয় উদ্যানের বড় অংশ জুড়ে বয়ে গিয়েছে কর্ণাবতী বা কেন নদী

মাদাম কাস্তাফিয়োরের হারিয়ে যাওয়া রত্ন উদ্ধার হয়েছিল পাখির বাসা থেকে। টিনটিন-হ্যাডকের মতো ‘পান্না কোথায়’ নিয়ে অত না ভেবেও একটি দুর্মূল্য পান্না আপনিও পেতে পারেন। তার জন্য যেতে হবে মধ্যপ্রদেশে। সে রাজ্যে বাকি জঙ্গলের তুলনায় জনপ্রিয়তার দৌড়ে পান্না জাতীয় উদ্যান বেশ পিছিয়ে। তবে প্রকৃতি কিন্তু তাকে সাজাতে কোনও কার্পণ্য করেনি। বর্ষায় এর ঘন সবুজ রং হার মানাবে যে কোনও খনির দুর্মূল্য পান্নাকে। তবে যদি জঙ্গল ভাল ভাবে উপভোগ করতে চান, আপনাকে যেতে হবে শীত অথবা বসন্তে।

Advertisement
অরণ্যকে সাজাতে প্রকৃতি কোনও কার্পণ্য করেনি

অরণ্যকে সাজাতে প্রকৃতি কোনও কার্পণ্য করেনি


মধ্যপ্রদেশের দু’টি জেলা পান্না এবং ছতরপুর জুড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বর্গকিমি এলাকা নিয়ে বিস্তৃত এই জাতীয় উদ্যান। এর প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই বাঘ। বলা হয়, গহীন জঙ্গলে আপনি তাকে দেখতে না পেলেও বাঘ আপনাকে ঠিকই দেখে নেয়। তার পর ঠিক করে, আপনাকে দেখা দেবে কি না। তাই আপনি বাঘের দেখা পেলে জানবেন সেটা বাঘেরই মেজাজ-মর্জি। সুন্দরবনের মউলিদের কাছে যার দেখা পাওয়া চরম দুর্ভাগ্যের, শহুরে পর্যটকের কাছে সেটাই শৌখিনতা। জঙ্গলসফরে হুডখোলা জিপে শুধু বাঘের জন্য এদিক ওদিক তাকালে কিন্তু সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না।

মাঝে মাঝেই তারা হয়তো আপনার পথ অবরুদ্ধ করে দাঁড়াতে পারে

মাঝে মাঝেই তারা হয়তো আপনার পথ অবরুদ্ধ করে দাঁড়াতে পারে


তার থেকে, প্রাণভরে জঙ্গলের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ পান করুন। বাঘের ইচ্ছে হলে আপনার সামনে ঠিক আসবে। বাঘ ছাড়াও পান্নার জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ায় লেপার্ড। চার দিকে চরে বেড়ায় চিতল, চিঙ্কারা, বারাশিঙা, নীলগাই এবং সম্বর। ওদের অত খেয়ালখুশি নেই। সহজেই দেখা দেয় পর্যটকদের। তাই মাঝে মাঝেই তারা হয়তো আপনার পথ অবরুদ্ধ করে দাঁড়াতে পারে। জিপের শব্দে তাদের প্রাতরাশ বা দুপুরের খাবারের ব্যাঘাত ঘটলে হয়তো একটু মুখ তুলে চোখাচোখিও করতে পারে আপনার সঙ্গে। চার পাশের সঙ্গে খেয়াল রাখবেন আকাশ বা গাছের দিকেও। পান্নার বাসিন্দা হরেক রকমের পাখিও কিন্তু আকর্ষণের দাঁড়িপাল্লায় কিছু কম যায় না।

জঙ্গলসাফারির জন্য আসন আগে থেকে বুক করে রাখা দরকার

জঙ্গলসাফারির জন্য আসন আগে থেকে বুক করে রাখা দরকার


মাডলা এবং হিনৌলতা, এই দু’টি গেট দিয়ে মূলত জঙ্গলসাফারি হয়। দিনে দু’বার পর্যটকরা জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি পান। ভোরবেলা এবং বিকেলে। সন্ধে নামার আগে সব গাড়ি বেরিয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় জঙ্গল এবং জনপদের মাঝের ভারী ফটক। জঙ্গলসাফারির জন্য আসন আগে থেকে বুক করে রাখা দরকার। হোটেল বা রিসর্ট থেকেই সাধারণত সব বুকিং করে দেওয়া হয়।

বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তৃণভোজীদের বিচরণ

বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তৃণভোজীদের বিচরণ


জঙ্গলের বেশির ভাগ অংশই ‘কোর এরিয়া’। জীবজন্তুদের সেই আপন দেশে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে যে এলাকায় সাফারি করা যায়, তার পরিমাণও কিছু কম নয়। সেখানে ঘুরতে ঘুরতেই দূরে নদীর ও পারে দেখবেন ভাঙা গড়। সে ছিল রাজাদের শিকারগড়। মন্দিরে পুজো দিয়ে ওখানেই মাচা বেঁধে বসতেন রাজারা। বাঘ শিকারের পরে প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন। এখন ওই এলাকা কোর এরিয়া। পর্যটকরা যেতে পারবেন না। তবে বাঘের কাছে ওই এলাকা এখনও খুব প্রিয়। সে রকম একটি শিকারগড়ের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাবেন কোর এরিয়ার বাইরেও। জঙ্গলের মাঝে গহ্বরের মধ্যে গাছগাছালির আড়ালে ভাঙা সেই প্রাসাদ দেখলে দিনের আলোতেও গা শিরশির করে ওঠে।

পান্না জাতীয় অরণ্যেরই অংশ এই ‘পাণ্ডব গুহা’

পান্না জাতীয় অরণ্যেরই অংশ এই ‘পাণ্ডব গুহা’


ওই গা ছমছমে পরিবেশেও বাঘ, লেপার্ডের মতো পায়া ভারী চতুষ্পদরা বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনাকে দেখা নাও দিতে পারে। এক জন কিন্তু পান্নার সঙ্গলে সবসময় আপনার সঙ্গে সব সময় থাকবে। কখনও ডান দিকে, কোনও সময় বাঁ দিকে, আপনার সঙ্গে বনভ্রমণ করছে কেন নদীও। কোনও এক সময় তার ভালনাম ছিল কর্ণাবতী। ওই ভারী নাম উচ্চারণ করা দুষ্কর। তাই ব্রিটিশরা নিজেদের সুবিধের জন্য করে নিয়েছিল ‘কেন’। নাম ছোট হলেও দাপট কমেনি। মধ্যপ্রদেশের কাটনি জেলায় বারনার পাহাড় থেকে বেরিয়ে গোটা বুন্দেলখণ্ডের মধ্যে দিয়ে ‘লং মার্চ’ করেছে। শেষে মধ্যপ্রদেশ থেকে উত্তরপ্রদেশে ঢুকে যমুনার সঙ্গে মিশে গিয়েছে | সম্পূর্ণ যাত্রাপথে পেরিয়েছে মোট ৪২৭ কিমি পথ। বুন্দেলখণ্ডে তার আর এক বোনের নাম বেত্রবতী, বা বেতওয়া।

কর্ণাবতী নদীর গিরিখাত মুগ্ধ করে পর্যটকদের

কর্ণাবতী নদীর গিরিখাত মুগ্ধ করে পর্যটকদের


পান্নার জঙ্গলে কর্ণাবতীতে নৌকাবিহার মনোরম অভিজ্ঞতা। নদী জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বড় বড় পাথরের খণ্ড। তার উপরে বিশ্রাম নিচ্ছে জটায়ুর করালকুম্ভীরের দল। কোথাও একা। কোনও চাঁইয়ের উপর সন্তানাদি-সহ। পাথরের রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছে তারা, স্বয়ং ডমরুধরেরও প্রস্তরে কুম্ভীর-বিভ্রাট হতে বাধ্য!

দিনের বিভিন্ন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যায় পাথরের বর্ণ

দিনের বিভিন্ন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে যায় পাথরের বর্ণ


জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ নিয়ে অপেক্ষমাণ পান্না অভয়ারণ্যের এক জায়গায় প্রায় ৯৮ ফুট উপর থেকে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এক উদ্দাম অনামী জলধারা। অতটা লাফিয়ে কিছু ক্ষণের বিরতি নিয়ে তৈরি করেছে একটা ছোট্ট জলাশয়। কিন্তু ধীর স্থির হয়ে থাকা বেশিক্ষণ পোষায়নি। আবার সে কুলকুল করে এগিয়েছে, কেন নদীতে পড়বে বলে। ঝোড়া ঝরনা আর জলাশয়ের পাশেই আছে একসারি গুহা। প্রাকৃতিক, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পরে সেই গুহাতেই মানুষের হাত তৈরি করেছে কুলুঙ্গি। গুহায় ঢোকার সময় ঝরনার জল গা ইতস্তত ভিজিয়ে দেয় ঠিকই। কিন্তু গুহাগুলির দেওয়ালে পানমশলার হোলিখেলা দেখে আহত মনে প্রলেপ দিতে পারে না। এই গুহাগুলির নাম ‘পাণ্ডব গুহা’। বলা হয়, মহাভারতে অজ্ঞাতবাসকালে এখানে আশ্রয় নিযেছিলেন কৌন্তেয়রা। তাঁরা আমার আপনার থেকে অনেক বেশি সাবলীল ছিলেন। তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি পাণ্ডব গুহায় যাওয়ার কথা ভাববেন হাঁটুর পারফরম্যান্সের কথা চিন্তা করেই। কারণ ৯৮ ফুট নামতে হলে ভাঙতে হবে প্রায় ৪০০ সিঁড়ি।

পাথরের রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছে তারা, স্বয়ং ডমরুধরেরও প্রস্তরে কুম্ভীর-বিভ্রাট হতে বাধ্য!

পাথরের রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছে তারা, স্বয়ং ডমরুধরেরও প্রস্তরে কুম্ভীর-বিভ্রাট হতে বাধ্য!


সিঁড়িভাঙা শেষ হলে জিরিয়ে নেওয়ার জন্য বেশি ক্ষণ বসবেন না। এ বার গাড়িকে যেতে বলুন ‘রানেহ ফলস’-এর দিকে। পান্না থেকে যেতে হবে পড়শি জেলা ছতরপুরে। এখানে কেন নদী বয়ে চলেছে ৯৮ ফুট গভীরে ৫ কিলোমিটার লম্বা গিরিখাত তৈরি করে। তাকে ঘিরে আছে গ্র্যানাইট আর ডলোমাইট পাথরের খাড়াই সারি। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, সার দিন ধরে সেই পাথরের সারির রং ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যায়। কোনও পাথর সবুজ। কোনওটা আবার গোলাপি। কোথাও হয়তো ধূসরের সঙ্গে মিশেছে নীলচে প্রলেপ। শীতের সকালে বা বিকেলে সেই রূপ অপার্থিব। বর্ষায় এই পাথরে ঢাল ছাপিয়ে আছড়ে পড়ে ঝর্না। শীতে অবশ্য তার খাত শুকনো। শুধু পাথরের গহ্বরে ধরা আছে তার পান্না সবুজ জল। তবে ‘রানেহ ফলস’ দেখে বেলাবেলি পান্নার হোটেলে ফেরার চেষ্টা করবেন। কারণ দু’টি জেলার মাঝে ৩ বছর আগেও রাস্তা ছিল বেহাল। দীর্ঘ দূরত্ব অবধি কার্যত কোনও পথ ছিল না। আর যেটুকু অংশে সড়ক ছিল, তার দু’পাশে আলোর বালাই ছিল না। পথ দেখার জন্য ভরসা গাড়ির হেডলাইটই।

মধ্যপ্রদেশ বললেই নর্মদার গিরিখাত এবং মার্বেল রক। অথবা কানহা বান্ধবগড়ের বাঘ। পর্যটকদের কাছে কিছুটা দুয়োরানি হয়েই পড়ে আছে পান্না এবং কর্ণাবতী নদী। তাদের এক বার সুয়োরানি হওয়ার সুযোগ দিয়েই দেখুন না! হয়তো আপনার চেতনার রঙে পান্না হবে আরও সবুজ।

কলকাতা থেকে কীভাবে যাবেনঃ

নিকটতম রেলস্টেশন সাতনা। কলকাতা থেকে রেলপথে সাতনা গিয়ে তার পর সড়কপথে ৭৫ কিমি পেরিয়ে আসতে হবে পান্নায়। মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য শহর ভোপাল, ইনদওর, গ্বালিয়র, জব্বলপুর থেকে পান্নাগামী লাক্সারি বাস পেয়ে যাবেন।

Advertisement