Editorial News

এই পরিবর্তনের কথাই কি বলা হয়েছিল ২০১১-এ?

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের প্রক্রিয়াকে ঘিরে রাজ্য জুড়ে তীব্র হিংসার ছবি দেখা গেল। দুষ্কৃতীদের উন্মত্ত তাণ্ডব দেখা গেল। বিরোধীদের রক্তাক্ত হতে দেখা গেল। পুলিশ-প্রশাসনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেল।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩৬
Share:

ফাইল চিত্র।

বৃহদাকারে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুখ খোলেন না। এমন অভিযোগ অনেকেই করে থাকেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও এই অভিযোগ শোনা যায়। ঠিক একই অভিযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও ওঠার উপক্রম যখন হল, তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ খুললেন। কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত বার্তাটা এল না। পর্বতের মূষিক প্রসব হল। অথবা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতানুসারে, পরিস্থিতির অবনতির পথ আরও প্রশস্ত হল।

Advertisement

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের প্রক্রিয়াকে ঘিরে রাজ্য জুড়ে তীব্র হিংসার ছবি দেখা গেল। দুষ্কৃতীদের উন্মত্ত তাণ্ডব দেখা গেল। বিরোধীদের রক্তাক্ত হতে দেখা গেল। পুলিশ-প্রশাসনকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেল। বিভিন্ন এলাকায় সংবাদমাধ্যমের কাজে বাধা দেওয়া হল বা হস্তক্ষেপ করা হল এবং সাংবাদিকদের হেনস্থা করা হল। এক চিত্রসাংবাদিককে প্রায় নগ্ন করে আটকে রাখা হল। নিয়মরক্ষার জন্য হলেও মুখ্যমন্ত্রী এ সবের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন— প্রত্যাশিত ছিল এমনটাই। কিন্তু সব প্রত্যাশা নস্যাত্ করে মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমের দিকেই আঙুল তুললেন। মিথ্যা খবর প্রচারিত হচ্ছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কুত্সা চলছে বলে দাবি করলেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটছে বলে যে ছবি দেখানো হচ্ছে, সে সব সাম্প্রতিক ছবিই নয়, পুরনো ছবি— এমন মারাত্মক অভিযোগ আনলেন।

মুখ্যমন্ত্রী কিছু পরিসংখ্যানও দিলেন, অবশ্যই নিজের মতো করে। সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিলেন। জানালেন যে ৫৮ হাজার আসনে নির্বাচন হচ্ছে, বিরোধীরা ৭৪ হাজার আসনে প্রার্থী দিয়েছেন। অপ্রীতিকর ঘটনা ছ’সাতটি জায়গায়। বাকি সব ভুয়ো খবর।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

প্রশ্ন হল, আসন যদি ৫৮ হাজারই হয় আর বিরোধী প্রার্থীর সংখ্যা যদি ৭৪ হাজার হয়, তা হলেও কি প্রমাণ করা যায় যে নির্বাচন অবাধ হচ্ছে? তৃণমূল ছাড়াও তিনটি বৃহত্ রাজনৈতিক অস্তিত্ব সক্রিয় এ রাজ্যে— বিজেপি, বামফ্রন্ট, কংগ্রেস। তিনটি পক্ষই যদি ৫৮ হাজার করে আসনে লড়তে পারত, তা হলে তো তাদের মোট প্রার্থীর সংখ্যা ১ লক্ষ ৭৪ হাজার হওয়ার কথা। শুধু ৭৪ হাজার হল কেন? ১ লক্ষ প্রার্থী কম কেন?

মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা বিরোধীদের লোক নেই। ঠিক এই ব্যাখ্যাই তো তাঁদের মুখ থেকেও শোনা যাচ্ছিল, যাঁদের নেতৃত্বে জেলায় জেলায় তাণ্ডবটা চলছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্যেও একই সুর শোনা যাবে, এমনটা প্রত্যাশিত ছিল কি?

আরও পড়ুন: তৃণমূলের ‘প্রভুত্বে’ সুর বদল পরিবর্তনপন্থীদের

আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত ভোট ঘিরে কোনও অশান্তিই হয়নি! দাবি মমতার

সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে যে ভাবে তিনি আঙুল তুলেছেন, তাতে প্রথমত বলতে হয়, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী কোনও ব্যতিক্রমী কাজ করেননি। প্রশ্নের মুখে পড়লে অধিকাংশ রাজনীতিকই সংবাদমাধ্যমের দিকেই আঙুলটা তোলেন। অপ্রীতিকর প্রশ্নের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় এটিই। কিন্তু দ্বিতীয়ত এ প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন তুলতে হয়। মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, সংবাদমাধ্যম মিথ্যাকে সত্য বলে চালাচ্ছে, যা আসলে ঘটেনি, তা-ই ঘটেছে বলেছে দেখাচ্ছে, সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে এই অপপ্রচার চালাচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে তিনি আইনি পদক্ষেপ করবেন বলেও মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, আইনি পদক্ষেপটা উনি এখনও করেননি কেন? যদি সত্যিই মিথ্যাকে সত্য বলে চালানো হয়, যদি সত্যিই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার হয়, তা হলে সে তো আইনত অপরাধ। সে সবের বিরুদ্ধে তত্ক্ষণাত্ পদক্ষেপ করলেন না কেন?

আরও পড়ুন: সাংবাদিক নিগ্রহের কথা জানা ছিল না, বললেন মমতা

বিজেপি, বাম, কংগ্রেস— সব এক হয়ে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ও তাঁর দল অটল। দিল্লিতে কুস্তি আর বাংলায় দোস্তির নীতি নিয়ে চলেন না— এমন মন্তব্যও শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে।

এই মন্তব্য খুব চেনা চেনা ঠেকছে না কি? দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজত্বকালের শেষ দিকে পৌঁছে বাম নেতৃত্বের মুখে বিরোধীদের সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা শোনা যেত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাগুলো ঠিক সেই রকমই শোনাচ্ছে না কি?

আরও পড়ুন: বিজেপির সঙ্গে বাম-কংগ্রেস, অভিযোগ মমতার

বিরোধীদের লোক নেই বলে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেননি, সংবাদমাধ্যম অপপ্রচার করছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কুত্সা চলছে— সব মন্তব্যই ক্ষমতার অলিন্দ থেকে বিদায়ী বামেদের কথাবার্তার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে না কি?

এ ভাবে সবটা মিলে যাবে, এমন প্রত্যাশিত ছিল না! এমনটা তো প্রতিশ্রুতও ছিল না! উন্নততর বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। ‘বদলা নয়, বদল চাই’-এর মহত্ অঙ্গীকার ছিল। পরিবর্তনের অঙ্গীকার ছিল।

এ কোন পরিবর্তন, যেখানে দিনের পরিবর্তনপন্থী বিদ্বজ্জনদের একাংশকে আবার এগিয়ে আসতে হচ্ছে প্রতিবাদে, সাংবাদিক সম্মেলন করে বলতে হচ্ছে, এই পরিবর্তন তাঁরা চাননি!

‘এই পরিবর্তন চাইনি’ বলে মুখ খুললেন যাঁরা, বিদ্বত্ সমাজের সেই অংশের আসলে একটা বিশেষ রাজনৈতিক ঝোঁক রয়েছে— অনেকটা এমনই ইঙ্গিত এল মুখ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে।

পরিবর্তন হয়েছে বই কি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন