শহরজুড়ে কৃত্রিম আলো, বাড়ছে স্থূলত্ব, ক্যানসার। ছবি: ফ্রিপিক।
ঝলমলে আলোই নাকি দূষণের কারণ! সন্ধ্যা নামলেই গোটা শহর সেজে ওঠে আলোকমালায়। উৎসবের দিনে কৃত্রিম আলোর ঝলমলানি বেশি থাকে, তবে এমনি দিনেও তা কম নয়! রেস্তরাঁ, শপিং মল থেকে রাস্তার দোকান, বাজার সর্বত্রই আলোর দাপট। বাড়ির বাইরের বাতিস্তম্ভের আলো থেকে শুরু করে তীব্র হ্যালোজেনের আলো, রঙিন নিয়ন আলো খানখান করে দিচ্ছে রাতের অন্ধকার। আর এই আলোই হয়ে উঠছে মানব শরীরের সবচেয়ে বড় শত্রু। দূষণের অভিধানে ‘আলোক দূষণ’ বা ‘লাইট পলিউশন’-এর কথা কিন্তু রয়েছে। এই দূষণে দূষিত হচ্ছে প্রায় সমগ্র বিশ্ব। আলোক দূষণ যে চোখের ক্ষতি করছে, তা নয়। এর থেকে বাড়ছে স্থূলত্ব, বাড়ছে ক্যানসারের ঝুঁকিও।
ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অফ আর্টিফিশিয়াল স্কাই লুমিনিসেন্সের সমীক্ষা বলছে বিশ্বের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই আলোক দূষণের শিকার। এর থেকে বাড়ছে স্থূলত্ব, টাইপ ২ ডায়াবিটিস ও অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকি। দেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থের গবেষণাতেও উঠে এসেছে আলোক দূষণের কথা। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, রাতের অন্ধকারে জোরালো কৃত্রিম আলো শরীরের ‘ঘড়ি’ বা সার্কাডিয়ান রিদ্মকে বদলে দিচ্ছে। কলকাতা, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহর আলোক দূষণের শিকার।
২০২৪ সালে ‘ডায়াবিটিস অ্যান্ড মেটাবলিজ়ম’ জার্নালে আলোক দূষণ নিয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছিল। গবেষকেরা জানিয়েছিলেন, শহর, ছোট জনপদ থেকে গ্রাম— সর্বত্রই সূর্যাস্তের পর থেকে জ্বলছে কৃত্রিম আলো। উৎসব-পার্বণের দিনে তা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। ইতালির এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ রাতে প্রকৃতির আলো বুঝতে পারেন না। তার কারণ, কৃত্রিম আলোর আধিক্য।
আলোর দূষণকে ‘লাইট ট্রেসপাস’, ‘ওভার ইলুমিনেশন’, ‘লাইট ক্লাটার’ ইত্যাদি নানা ভাগে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালের রিপোর্ট বলছে রাস্তায় বা বাইরের কোনও আলো যখন বাড়ির কাচের জানলা ভেদ করে ঘরে ঢুকে যায় তখন তাকে ‘লাইট ট্রেসপাস’ বলে। ‘ওভার ইলুমিনেশন’ দূষণে অতি উজ্জ্বল আলোয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আলোক দূষণ হয়। ‘লাইট ক্লাটার’-এর বৈচিত্রময় আলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, দিকভ্রষ্ট করে পশুপাখিদেরও। এতে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়।
২০১৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণা দেখিয়েছিল, কৃত্রিম আলোর দূষণ শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। এর থেকে ‘মেটাবলিক ডিজ়অর্ডার’ হতে পারে, যা স্থূলত্বের কারণ। কেবল তা-ই নয়, আলোক দূষণ অনিদ্রারও কারণ হয়ে উঠছে দিনে দিনে। আলো্র উৎস থেকে নিঃসৃত ফোটন কণা রেটিনায় পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে নিউরনের মাধ্যমে সঙ্কেত পৌঁছে যায় দুই গুরুমস্তিষ্কের মাঝে থাকা পিনিয়াল গ্রন্থিতে। পিনিয়াল গ্রন্থি মেলাটোনিন নিঃসরণ করে। রাতের বেলায় কৃত্রিম আলোকের উপস্থিতি রক্তে মেলাটোনিনের স্বাভাবিক ঘনত্বের পরিবর্তন করে, যা নিদ্রাহীনতা, বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বহু গুণে বাড়িয়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা তো কৃত্রিম আলোকের সঙ্গে স্তন ক্যানসারের যোগসূত্রও পেয়েছেন। দেখা গিয়েছে, যাঁরা বেশি সময় কৃত্রিম আলোয় থাকেন, তাঁদের ক্যানসারের ঝুঁকিও বেশি। এখন নিয়ন আলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতি উজ্জ্বল এলইডি আলো। অনেকেই ভাবেন, এলইডি আলোয় ক্ষতি কম হয়, তাই অত্যধিক হারে এর ব্যবহার চলছে। ফলে শরীরের ক্ষতিও বাড়ছে।