সিওপিডি-তে মৃত্যু প্রতি ১০ সেকেন্ডে! বাঁচব কী ভাবে?

ফুসফুসের এই রোগের শিকার কলকাতাও। বাচ্চা হোক কিংবা মধ্যবয়সি বা প্রবীণ, সকলের শরীরেই অলক্ষ্যে থাবা বসাচ্ছে এই রোগ। উপসর্গগুলি চিনে দ্রুত সতর্ক না হলে বিপদ অনিবার্য। লিখছেন দেবাশিস ঘড়াইচিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, সিওপিডি-র প্রধান কারণ হিসেবে প্রাথমিক ভাবে ধূমপানকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু এর জন্য ঘরে-বাইরের দূষণও কিছু কম দায়ী নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৯ ১০:৫৬
Share:

দূষণ-চিত্র পুরনো যানবাহন থেকে বেরোনো এমন কালো ধোঁয়াই বিষিয়ে তুলছে শহরের বাতাস। ছবি: সুমন বল্লভ

প্রথম বার যন্ত্রে ‘রিডিং’ দেখে চমকে উঠেছিলেন সকলে।

Advertisement

বায়ুদূষণের মাত্রা যে বেশি, তা এত দিন বিভিন্ন সূত্র থেকে শুনেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তা যে কতটা বেশি, তা আঁচ করতে পারেননি বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে সংলগ্ন ওই আবাসনের বাসিন্দারা। কিন্তু যখন নিজেদের কেনা ‘পোর্টেবল এয়ার কোয়ালিটি পলিউশন মিটার ডিটেক্টর’ যন্ত্রে তাঁরা দেখলেন বাতাসে অতি সূক্ষ্ম ভাসমান কণার পরিমাণ (পিএম ২.৫) সহনশীল মাত্রার থেকে প্রায় ছ’গুণ বেশি, রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। আতঙ্কের কারণ, তত দিনে বহুতলের বেশ কিছু বাচ্চার শ্বাসকষ্ট ও ক্রমাগত কাশি শুরু হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজ়িজ (সিওপিডি)-র প্রথম পর্যায় এটি। এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হওয়ার সম্ভাবনা। আবাসনের বাসিন্দা রায়ান ঘোষাল বলছেন, ‘‘অনেক বাচ্চারই শ্বাসের সমস্যা, কাশি শুরু হয়েছে। ডাক্তারেরা বলছেন, অতিরিক্ত দূষণের কারণেই এমনটা হচ্ছে। আমার শ্বশুরই সিওপিডি-তে ভুগে গত এপ্রিলে মারা গিয়েছেন।’’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রায় ৩১ লক্ষ রোগীর মৃত্যু হয়েছে এই সিওপিডি-র কারণে। সিওপিডি নিয়ে ‘হু’ যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকছে। কারণ ওই রিপোর্ট বলছে, ২০১৬ সালে সারা বিশ্বে এই রোগীর সংখ্যা ছিল ২৫ কোটি ১০ লক্ষ। প্রতি ১০ সেকেন্ডে সিওপিডি-তে আক্রান্ত হয়ে এক জন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: জীবনযাপনে অনিয়মই ডাকছে ডায়াবিটিস

ভুক্তভোগী স্কুলপড়ুয়াদের ধোঁয়া-ধুলো এড়াতে ভরসা সেই সাধারণ মাস্ক।—নিজস্ব চিত্র।

হু প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন এগেনস্ট সিওপিডি’ এবং ‘সিওপিডি ফাউন্ডেশন’-এর যৌথ সমীক্ষা রিপোর্টে এ-ও স্পষ্ট, কী ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সিরিয়ার মানচিত্র মিশে গিয়েছে সিওপিডি-র আগ্রাসনে। ওই রিপোর্টে মার্কিন যুক্তরাষ্টের এক রোগীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি হাসতে পারেন না। কারণ, হাসতে গেলে যে অতিরিক্ত শ্বাসবায়ুর প্রয়োজন হয়, তা ফুসফুস তাঁকে সরবরাহ করতে পারে না। সিরিয়ার এক জন রোগী আবার বলেছেন, সিওপিডি ধরা পড়ার পরে তিনি একা হেঁটে বাজারে যেতে পারেন না। কারণ, দম পান না! চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সিওপিডি-র আগ্রাসনের এই মানচিত্রে ব্রাত্য নয় কলকাতাও। রায়ানদের সন্তানের মতো শহরের অনেক বাচ্চা, মধ্যবয়সি, প্রবীণদের ফুসফুসে অলক্ষ্যে থাবা বসাচ্ছে সিওপিডি।

এর লক্ষণগুলি কী কী?

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, যে কোনও ধরনের শ্বাসকষ্ট—‘নিড ফর এয়ার’ই হল এর প্রথম লক্ষণ। ক্রমাগত কাশি, রাতে কাশির দমকে ঘুম ভেঙে যাওয়া, সিঁড়ি বা উঁচু জায়গায় ওঠানামার ক্ষেত্রে বুকে চাপ অনুভব করা বা শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়া, বুকের মধ্যে সাঁইসাঁই করা, এমন বেশ কিছু উপসর্গ দেখলেই বুঝতে হবে যে, দরজায় কড়া নাড়ছে সিওপিডি।

কিন্তু মুশকিল হল, এই শ্বাসকষ্টকে বেশিরভাগ মানুষই প্রথমে উপেক্ষা করেন। সাধারণ সর্দি-কাশি বা ধূমপানের কারণে এই শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে তাঁরা প্রথমেই ধরে নেন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এখানেই লুকিয়ে রয়েছে বিপদ। কারণ, সাধারণ কাশি দিয়ে শুরু হলেও পুরো বিষয়টি মোটেই আর সাধারণ থাকে না। কিছুদিনের মধ্যে তা দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের রোগের আকার নেয় এবং নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। ফলে ক্রমশ কমতে থাকে ফুসফুসের ক্ষমতা। বক্ষরোগ চিকিৎসক রাজা ধর বলেন, ‘‘ধারাবাহিক ভাবে কাশি বা সর্দি চলতে থাকলে তাকে অগ্রাহ্য করা উচিত হবে না। এ ধরনের লক্ষণ দেখলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ, চিকিৎসক পরীক্ষা করে বুঝতে পারবেন, ভিতরে কত পরিমাণ অক্সিজেন কম ঢুকছে বা শ্বাসনালীর সঙ্কোচন হচ্ছে। সেইমতো চিকিৎসা শুরু হবে।’’

আরও পড়ুন: বন্ধ্যত্বের সমস্যায় আগে দরকার কাউন্সেলিং, বলছেন চিকিৎসকেরা

চিকিৎসকেরা আরও জানাচ্ছেন, সিওপিডি-র প্রধান কারণ হিসেবে প্রাথমিক ভাবে ধূমপানকেই দায়ী করা হয়। কিন্তু এর জন্য ঘরে-বাইরের দূষণও কিছু কম দায়ী নয়। ঘরের মধ্যে কাঠকয়লায় আগুন জ্বালানো বা অন্য কোনও কারণে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, তার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সিওপিডি-র বিপদ। এর সঙ্গে বাইরের দূষণ তো রয়েছেই। হু-র রিপোর্ট জানাচ্ছে, সিওপিডি-তে মৃত্যুর ঘটনার ৯০ শতাংশই হয়েছে নিম্ন ও মধ্য আর্থিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশে। কারণ, ধূমপান, জ্বালানি, ধোঁয়া-ধুলোর মধ্যে জীবনযাপন এর বিপদ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। রাজাবাবুর কথায়, ‘‘বাড়িতে অনেকে মশা মারার কয়েল জ্বালান। মনে রাখতে হবে, ছ’ঘণ্টার এরকম একটি কয়েল দিনে ১০০টি সিগারেটের সমান। তাই সিওপিডি এড়াতে গেলে ধূমপান তো ছাড়তেই হবে, উল্টে প্যাসিভ স্মোকিংও এড়াতে হবে। ধোঁয়া-ধুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে।’’

এই ধোঁয়া-ধুলো এড়াতে অনেকে মুখে মাস্ক পরেন। তবে শ্বাসনালী, ফুসফুস অক্ষত রাখতে ওই মাস্কের কতটা সদর্থক ভূমিকা রয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য নিশ্চিত নন চিকিৎসকেরা। কারণ, সে রকম কোনও সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত হয়নি। তবে সাধারণ মাস্ক পরে খুব একটা লাভ হয় না বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশ। কারণ, সাধারণ মাস্ক বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা বা অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার প্রবেশ আটকাতে পারে না। বিশেষ করে যাঁদের ধোঁয়া-ধুলোর মধ্যেই দিনের অনেকটা সময় কাটাতে হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে সাধারণ মাস্ক মোটেই কার্যকর নয় বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা। বক্ষরোগ চিকিৎসক পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ধোঁয়া-ধুলোর ক্ষেত্রে এন৯৯ মাস্ক তুলনামূলক ভাবে বেশি উপকারী। কারণ, ওই ধরনের মাস্ক ভাসমান ধূলিকণাকে ভিতরে ঢুকতে বাধা দেয়। তাতে কিছুটা হলেও সুবিধা হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন