আমেরিকার ধনকুবের, টেসলার কর্ণধার ইলন মাস্ক নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেছেন।
নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেছেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। জানিয়েছেন, তাঁর ‘আমেরিকা পার্টি’ ২০২৬ সালের ‘মিড-টার্ম ইলেকশন’-এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। আমেরিকার মানুষকে ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’ এনে দেওয়া মাস্কের এই নতুন দলের লক্ষ্য। কিন্তু আমেরিকার গণতন্ত্রে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দু’টি দল রিপাবলিকান পার্টি এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় থেকে কী ভাবে তৃতীয় দল তৈরি করলেন মাস্ক? আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় এই দলের বৈধতা কতটা? কী ভাবে মাস্ককে জায়গা করে নিতে হবে? বিশেষজ্ঞেরা এ বিষয়ে নানা মত দিচ্ছেন। অধিকাংশই মেনে নিচ্ছেন, কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়ালেন মাস্ক। অন্তত ছ’টি চ্যালেঞ্জ তাঁর ‘আমেরিকা পার্টি’র জন্য অপেক্ষা করে আছে। এই লড়াই একেবারেই সহজ হবে না। মাস্ক বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। অর্থ তাঁকে এ ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা করে দিতে পারে। তবে টাকার জোরে টেসলার কর্ণধার আমেরিকার রাজনীতির ময়দানে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবেন কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞেরা সন্দিহান।
প্রাতিষ্ঠানিক বাধা
আমেরিকার দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় তৃতীয় দলের জন্য নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তৃতীয় দল একেবারেই যে অবৈধ, তা নয়। তারা ভোটে লড়তেও পারে। তবে পথ মসৃণ নয়। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হবে মাস্ককে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ইতিহাসের অধ্যাপক হান্স নোয়েল বলেন, ‘‘বহু দল বা তৃতীয় দলের জন্য উন্মুক্ত সফল কোনও প্রতিষ্ঠান আমেরিকায় নেই। কিছু পেতে গেলে সরাসরি জিততে হবে। এটা অন্যান্য গণতন্ত্রের মতো নয়, যেখানে আপনি ছোটখাটো একটা দল শুরু করলেন, ২০-৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে গেলেন আর আইনসভায় কিছু আসনের ভাগ পেয়ে গেলেন।’’ আমেরিকার ব্যবস্থায় জয়ী দলই সব পায়। যদি মাস্ক বিভিন্ন প্রদেশের ফেডেরাল প্রার্থীদের সমর্থন করতে চান কিংবা নিজে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তৈরি করতে চান, তা হলে ব্যালট পাওয়ার জন্য তাঁকে বিবিধ প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হবে। নতুন দলের নথিভুক্তকরণের জন্য আমেরিকার প্রাদেশিক এবং ফেডেরাল নির্বাচন কমিশনের একাধিক নিয়ম রয়েছে। প্রদেশগুলির নিজস্ব নিয়মও রয়েছে। ব্যালটে নাম তুলতে হলে ভোটারদের কাছ থেকে অনেক স্বাক্ষর (পিটিশন সিগনেচার) জোগাড় করতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞেরা মানছেন, ভোটারদের কাছ থেকে স্বাক্ষর জোগাড়ের সামর্থ্য মাস্কের আছে।
তৃতীয় দলের ইতিহাস
আমেরিকায় এর আগেও একাধিক বার তৃতীয় দল চালুর চেষ্টা করা হয়েছিল। দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বাইরে তৃতীয় দলের অস্তিত্ব আগেও ছিল। কিন্তু জাতীয় স্তরে তাদের আবেদন সীমিত। শেষ বার তৃতীয় দলের প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছেন ১৯৬৮ সালে। সে বার আমেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির প্রার্থী ছিলেন জর্জ ওয়ালেস। ১৯৯২ সালে মার্কিন ধনকুবের রস পেরটও ১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট পাননি। ২০০০ সালে র্যাল্ফ নাদের গ্রিন পার্টির হয়ে প্রেসিডেন্ট ভোটে লড়েছিলেন। ফ্লরিডার ফলাফল কঠিন করে দিয়েছিলেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের পরে রিপাবলিকান নেতা জর্জ বুশ জেতেন। কিন্তু নাদেরও ইলেক্টোরাল ভোট পাননি।
কৌশলগত সীমাবদ্ধতা
স্পার্টানদের বিরুদ্ধে গ্রিক জেনারেল এপামিননডাসের কৌশলের সঙ্গে নিজের কৌশলের তুলনা করেছেন মাস্ক। এর আগে সেনেট এবং হাউস অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভ্সের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিযোগিতায় মনোনিবেশ করে কংগ্রেসের গঠনকে প্রভাবিত করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন মাস্ক। তবে নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য স্থির করার কথা জানাননি। বিশেষজ্ঞেরা অধিকাংশই মনে করছেন, মাস্কের প্রার্থীরা জিততে পারবেন না। তবে তাঁরা যে ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারবেন, ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে পারবেন এবং রিপাবলিকানদের ভোট কাটতে পারবেন, এ কথা সকলেই মানছেন। উত্তর ক্যারোলিনার মতো প্রদেশে পার্থক্য গড়ার মতো ভোট মাস্কের প্রার্থীরা পেয়ে যেতে পারেন। ট্রাম্পের বিলের বিরোধিতা করেছেন মাস্ক। বিভিন্ন সমীক্ষায় দাবি, সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানও ওই বিলের বিরুদ্ধে। এটা মাস্কের পক্ষে যেতে পারে।
একতার অভাব
মাস্কের সমর্থকদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার অভাব রয়েছে বলে মার্কিন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত। সবে তিনি নতুন দল গঠন করেছেন। এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমর্থকদের মধ্যে যতটা একতা দরকার, তা মাস্কের পক্ষে আনা কঠিন। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকানেরা দ্বিধাবিভক্ত। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটদের প্রতি তাঁদের ব্যক্তিগত স্তরে দায়বদ্ধতা রয়েছে। সকলে কোনও না কোনও দলের সমর্থক। আবার অনেকে এই রাজনৈতিক দলের কাজে হতাশ। মাস্কের নিজস্ব কোনও নির্বাচনী এলাকা নেই। ফলে তাঁর দলের রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। তা গড়ে তোলা সহজ হবে না।
রাজনৈতিক ‘বন্ধু’
২০২৪ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পের হয়ে ঢালাও প্রচার করেছিলেন মাস্ক। কিন্তু ‘বড় ও সুন্দর’ বিলকে কেন্দ্র করে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বিবাদ প্রকাশ্যে আসে। এখন রিপাবলিকানদের মধ্যে মাস্কের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা প্রায় তলানিতে। রিপাবলিকানদের অনেকেই মাস্কের রাজনৈতিক প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করতে উদ্যোগী হয়েছেন। নতুন পার্টিকে দাঁড় করাতে গেলে চাই অস্বাভাবিক রকমের ভোটার সমর্থন। বিপুল শক্তি নিয়ে তাঁকে প্রচারে ঝাঁপাতে হবে। প্রথম দিকের হার মেনে নিতে হবে। পিছু হটলে চলবে না। এটা টাকা দিয়ে কেনা যাবে না। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কংগ্রেসে অন্তত এক জন রিপাবলিকান আছেন যাঁকে মাস্ক এখনও সমর্থন করে চলেছেন। তিনি টমাস ম্যাসি। এ ছাড়া দু’টি অরিপাবলিকান গোষ্ঠীও মাস্কের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহী। তবে রাজনৈতিক ‘বন্ধু’ সংগ্রহের কাজে ঝাঁপাতে হবে মাস্ককে।
ধৈর্য আছে?
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, ‘আমেরিকা পার্টি’কে শক্তিশালী করতে ধৈর্য ধরতে হবে মাস্ককে। সেটা তিনি করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনেকেই সংশয়ে। কারণ স্পেসএক্সের মালিকের মেজাজের পরিচয় আগেও একাধিক বার পাওয়া গিয়েছে। অধ্যাপক হান্স বলেন, ‘‘প্রচলিত নিয়মের বাইরে বেরোতে চাওয়াই যাঁর অভ্যাস, কর্মীদের জন্য যিনি উচ্চ মানের লক্ষ্য স্থির করে দেন, রকেট-গাড়ি তৈরি করেন, তিনি কি ব্যালটে নাম তোলানোর জন্য ধৈর্য ধরতে পারবেন? যে অসংখ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তার সঙ্গে পেরে উঠবেন? টাকা দিয়ে ভোটার কিনতে পারবেন কি?’’