ড়িশা- ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে প্রান্তিক স্টেশন বারবিল। ছোটনাগপুর মালভূমির গল্প পড়তে আসা বোহেমিয়ানদের কাছে দু-তিন রাতের সফর যেন শুরুতেই " লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট"। আসলে এ সফর অলস বিলাসিতার। এখানে লোহাচুরের গন্ধ মাখা আগুন বাতাস আর বাদামি ঝরাপাতার স্তূপের বাঁকে পাক খেতে খেতে পথ হারিয়ে যায় বোলানির পেটে। আর সেখান থেকেই এ পথে-সে পথে কিরিবুরুর ভালবাসার গোপন চিঠি খোলে ধীরে ধীরে।
প্রকৃতি চেনানোর সহজ পাঠের সফরে মেতে ওঠা আদিবাসী গাড়িচালক শিবশঙ্কর, ধান্নো বা বাবুলা অকপটে কলকাতার বাবুদের শোনায় জঙ্গলগাথা। চেনায় বহেড়া, লাল-কুসমি, সেগুন, শাল, আমলকি, আর লেবুগাছের প্রকৃতি বাসর। হো, মুন্ডা, ওঁরাও বা সাঁওতালদের দাওয়াতে আদিবাসী জীবনের মতোই শুকোতে থাকা হলুদ ফুলের গন্ধে ডুবতে ডুবতে মহুয়ার মৌতাত নিতে শেখায় তারা। দেখায় হাতি চলাচলের পথ।
নিশুতি রাতে শুক্লপক্ষের মায়াবী চাঁদের রুপোলি আলোর ছটা যখন মাথা উঁচু করে জেগে থাকা গাছপালা আর থমকে থাকা টাঁড়-টিলা-পাহাড়ের সঙ্গে আলাপ জমায়, হলুদ বসন্ত পাখি যখন আমলকি গাছের কোটরে নিশ্চিন্তে রাত কাটায়, চুপিচুপি ঝরে পরা রাত শিশিরের মিহি চুমুতে লোহা পাথরের বুক যখন গলতে থাকে ধীরে ধীরে, ঠিক তখনই জঙ্গলের অন্য প্রান্তে ভেসে আসা অস্পষ্ট মাদলের বোল জানান দেয় ফি শুক্কুরের হাট বসেছে ডব্লিউ হাটিং-এ।
পরদিনও জঙ্গলসফর। শিবশঙ্করের বোলেরো সেঁধিয়ে যায় লাল সরাণের অন্দরে। হলদে সবুজ রোদ আর পাতারা কাটাকুটি খেলে আনমনে। দেখা হয় লাল নদী কারো আর ঝিকিরা ঝর্না। আগুনে ছায়ার ফাঁকে জীবনানন্দের কবিতা তৈরি হয় কাঁচপোকার পিঠে। এর পরে গাড়ি ঘোরে অন্য জঙ্গলের পথে। ঠাকুরানী পাহাড়ের পায়ের নীচে এ জঙ্গল জটেশ্বরের। অসহ্য এক নীরবতা জঙ্গলকে এনে ফেলেছে এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে। মিহি জলের ঝিরঝিরে শব্দ নেশা জাগায় মাতাল মনে।
পরের ভোর অলসতার নয়, ব্যস্ততার। তাই অনুমতি পত্র আর বানিয়ে নেওয়া খাবারে তৈরি হয়ে সোজা সারান্ডার অন্দরে। ডিএফও অফিসে অনুমতির নীলছাপ্পায় গাড়ি ঢোকে মেঘাতাবুরুর গহীনে। জঙ্গলের গভীরতার সবুজ অন্ধকার, কেন্দু আর মহাশালের নীরবতায় বুক কাঁপে আশঙ্কায়। গাড়ি থামে থলকোবাদের দোরগোড়ায়। শুকনো পাতার শতরঞ্চিতে বসলে মন থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়িয়ে আসে ছোটবেলার ভাস্কো ডা গামা আর লিভিংস্টোনেরা।
হতাশ মন জানান দেবে আজ এখানে সফরের শেষ রাত।শেষ রাতে আড্ডায়, বার-বি-কিউয়ে আগুন কণার মতোই মনে ভিড় করে জ্বলে ওঠে সফরের টুকরো ভাল লাগারা। তাই আধঘুমে চলে যাওয়া বাউন্ডুলে মনটাকে জড়িয়ে রাখে এক গল্প। এ গল্প তাই শেষ না হয়েও চলতে থাকে ঝিকিরার রুপোলি জলে, বুনোফুল আর প্রজাপতির সংসারে, আর সাতশো পাহাড়ের চুড়োয় ভিড় করা মেঘেদের সংসারে।
প্রয়োজনীয় তথ্য--- যাওয়া: কিরিবুরু আর মেঘাতাবুরু হল ওড়িশা (কেওনঝড়) ও ঝাড়খণ্ডের ( পশ্চিম সিংভূম) হাত ধরাধরি করে থাকা দু'টি যমজ জনপদ। যাওয়া ও আসার হাওড়া থেকে একমাত্র ট্রেন হাওড়া-বারবিল জনশতাব্দী এক্সপ্রেস। আপ ১২০২১: ছাড়ে সকাল ৬টা ২০ ও বারবিল পৌঁছয় বেলা ১২টা ৫০ । ডাউন ১২০২২: বারবিল স্টেশন থেকে ছাড়ে দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ও পৌঁছয় রাত ৮টা ৫৫-তে)। সারান্ডা সফরে একমাত্র অনুমতিপ্রাপ্ত গাড়ি যায়, তাই বারবিলকে কেন্দ্র করে এই সফর করতে প্যাকেজে টুর করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বিধিনিষেধ- সারান্ডার জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতিপত্র তৈরি করে নিতে হয় মেঘাতাবুরুর বন দফতরের অফিস থেকে, যা ছাড়া জঙ্গলে প্রবেশ নিষেধ। তার জন্য চাই সচিত্র পরিচয়পত্র (আসল) ও একটা স্বপ্রত্যায়িত (সেল্ফ অ্যাটেস্টেড) ফোটোকপি। জঙ্গলের গভীরে একা প্রবেশ করবেন না। এটি হাতি চলাচলের প্রধান পথ। জঙ্গলে থাকা ওপেনকাস্ট লোহার খনির ছবি তোলাতেও বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়। জঙ্গল ও জলপ্রপাত গুলিতে ঘোরাঘুরি করার জন্য উপযুক্ত জুতো পরুন। মনে রাখবেন, সারান্ডা সফরে প্যাকড লাঞ্চ নিয়ে যেতে হয়। ভিতরে খাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। ঘোরার সময়- তিন রাত-চার দিন অথবা দু'রাত-তিন দিনেও ঘোরা যায়। দু'রাতের ক্ষেত্রে সারান্ডা সফর অধরা রয়ে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy