Advertisement
১০ মে ২০২৪

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ

ভাষা আন্দোলন একটি মহান সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবেই পরিচিতি পায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই আন্দোলনের অর্থনৈতিক তাত্পর্য খুব বেশি। লিখছেন সৈয়দ আবুল মকসুদভাষা আন্দোলন একটি মহান সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবেই পরিচিতি পায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই আন্দোলনের অর্থনৈতিক তাত্পর্য খুব বেশি। লিখছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:০৭
Share: Save:

পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষে শুধু একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ভাষা আন্দোলনের তাত্পর্য বহুমাত্রিক: সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে উপমহাদেশের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা দুটিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম লিগকে ভোট না দিলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সম্ভব হত না।

সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ ছিল বাংলা ভাষাভাষী। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের সপ্তাহখানেকের মধ্যে ডাক বিভাগের খাম, পোস্টকার্ড ও অন্যান্য সরকারি ফর্মে ইংরেজির সঙ্গে শুধু উর্দু লেখা থাকায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার প্রতিবাদে খুব ছোট আকারে আন্দোলনের সূচনা করেন ঢাকার প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েটের চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণির বাঙালি কর্মচারীরা। অবিলম্বে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও যুবসমাজ। এর মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলি জিন্না ঘোষণা করে দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা— অন্য কোনও ভাষা নয়। তবে জিন্না এ কথাও বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা কি হবে তা এই প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে।


ভাষা শহিদ স্মরণে

উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার প্রতিবাদ জিন্নার মুখেরই উপরেই করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল ছাত্র। তিনি একা ওই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না যদি না পূর্ব বাংলার একশ্রেণির তাঁবেদার রাজনীতিবিদকে সমর্থক হিসেবে না পেতেন। তিনি সেই ভাষাটিকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন যে ভাষায় কবি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তা ছাড়া বাংলা ভাষার চেয়ে সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য পাকিস্তানে দ্বিতীয়টি ছিল না।

ভাষা আন্দোলন একটি মহান সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবেই পরিচিতি পায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই আন্দোলনের অর্থনৈতিক তাত্পর্য খুব বেশি। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন থেকে। অনেক আগে এক বার ধর্মীয় নেতাদের ফতোয়ার কারণে ইংরেজি না শিখে তারা বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত থেকে পৌনে এক শতাব্দী পিছিয়ে পড়ে। এ বার পাকিস্তানের সরকারি ভাষা উর্দু হলে তারা আবার উর্দুভাষীদের থেকে পিছিয়ে পড়বে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্নটি চুরমার হয়ে যাবে— এমন শঙ্কা দেখা দেয় মধ্যবিত্তের মধ্যে। বাঙালি মুসলমান শিক্ষায় পিছিয়ে পড়লে সরকারি চাকরি-বাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়বে। তখন সরকারি ভাষা অবশ্য ব্রিটিশ আমলের মতো ইংরেজিই ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণায় বাঙালি চাকুরিজীবীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দেয়। তাঁরা মনে করেন পাকিস্তানে প্রাধান্য পাবেন উর্দুভাষীরা, কারণ কেন্দ্রের শাসকরাও উর্দুভাষী। সে জন্য নেতৃত্বহীন ওই আন্দোলনে মধ্যশ্রেণির অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

ভাষা আন্দোলন ছিল একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। ওই আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িক মুসলিম জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে পূর্ব বাংলার মানুষ। ভাষা আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি সামনে আসে। তার ফলে ’৫৪-র প্রথম সাধারণ নির্বাচনেই মুসলিম লিগের ভরাডুবি ঘটে। মওলানা ভাসানী, ফজলুল হক ও শহিদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। বিশেষ করে মওলানা ভাসানীর আওয়ামি লিগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তা সম্ভব হয় একুশের আন্দোলনের প্রভাবে।

বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তের বিনিময়ে ১৯৫৬-র সংবিধানে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলেও অবাঙালি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহতই রাখে। দাবি তোলা হয়েছিল ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে আরবি— উর্দু বা বাংলা নয়। বলা হয়েছিল, আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের জনগণের সংহতি দৃঢ় হবে। শিক্ষিত সমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে আরবির প্রস্তাব বেশি দূর এগোয়নি।

বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষতি সাধন করতে আরও নানা রকম চক্রান্ত চলে। আরবি হরফে বাংলা লেখার দাবি তোলে একটি গোত্র। তাদের অদ্ভুত যুক্তি ছিল, পাকিস্তানের দুই অংশের সব ভাষা যদি আরবি হরফে লেখা হয় তা হলে জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় হবে। এক প্রদেশের ভাষা অন্য প্রদেশের মানুষ সহজে পড়তে পারবে। সে পরিকল্পনাও নস্যাত্ হয়। এর পর আসে রোমান অক্ষরে বাংলা লেখার প্রস্তাব। আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যেত। এই সব অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা থেকে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষা শাসকগোষ্ঠীর আক্রমণের বস্তুতে পরিণত হয়। সংস্কৃত প্রভাবযুক্ত মুসলমানি ভাবাশ্রিত বাংলা ভাষা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, এই সব অপচেষ্টায় এক শ্রেণির বাঙালি কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ জড়িত ছিলেন। তাঁদের শুধু সমর্থন নয়, সহযোগিতাও ছিল। ১৯৪৯ সালের মার্চে গঠন করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ কমিটি বা পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি। ওই কমিটির বিবেচনার বিষয় ছিল: ১. পূর্ব বাংলার মানুষের ভাষার (ব্যাকরণ, বানান, ইত্যাদি সমেত বাংলা ভাষার) সরলীকরণ, সংস্কার ও প্রমিতকরণের প্রশ্ন বিবেচনা করা এবং সে সম্পর্কে সুপারিশ করা। ২. বাংলা ভাষাকে নির্দিষ্ট ভাবে পূর্ব বাংলা এবং সাধারণ ভাবে পাকিস্তানের মানুষের প্রতিভা ও কৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিবেচনা করতে পারেন এমন অন্যান্য সুপারিশ কমিটি করতে পারবে।’ কমিটি পাকিস্তানি ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন এক সহজ রূপ দেওয়ার সুপারিশ করে। তাঁদের করা সুপারিশের একটি দৃষ্টান্ত: ‘তিনি যাবতীয় বিষয় আনুপূর্বিক অবগত হইয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন’, এর পরিবর্তে লিখতে হবে: ‘তিনি সব কিছু আগাগোড়া শুনিয়া তাজ্জব হইলেন।’

বাংলা বর্ণমালা ও ভাষা সংস্কারের দায়িত্ব যাঁদের উপর দেওয়া হয়েছিল তাঁরা শুধু সরকারের অনুগত ছিলেন তা-ই নয়, তাঁরা ছিলেন অবিশেষজ্ঞ। তা ছাড়া মতাদর্শের দিক থেকে ছিলেন সাম্প্রদায়িক। তাঁরা এক-তৃতীয়াংশ অমুসলমান সংখ্যালঘু বাঙালির আবেগ-অনুভূতির কোনও মূল্য দেননি। যে চেতনায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়, সেই চেতনা থেকেই বাংলা ভাষার ইসলামীকরণ, পাকিস্তানীকরণ ও আঞ্চলিকীকরণের অপচেষ্টা প্রতিহত করা হয়।

ভাষা সংস্কার কমিটি বাংলা ‘বর্ণমালা থেকে শুরু করে ব্যাকরণ পর্যন্ত আদ্যন্ত সংস্কার’-এর জন্য অভিমত দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিতসমাজের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। এর মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারপন্থী বেসরকারি কোনও কোনও গোত্র থেকে বাংলা ভাষা আমূল সংস্কারের নামে নানা উদ্ভট অপচেষ্টা হয়। তার একটি ‘শহজ বাংলা’ প্রবর্তনের চেষ্টা। ‘শহজ-বাংলা’ নামে এক নতুন বাংলা ভাষা বা পূর্ব পাকিস্তানি ভাষা সৃষ্টির প্রয়াস হয়। পূর্ব বাংলার প্রগতিশীলদের প্রতিরোধে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বাংলাদেশের মানুষের জীবনে অপরিমেয়। বাহান্নার ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনের এমন এক ঘটনা, সরকার দাবি মেনে নেওয়ার পরও তার চেতনা শেষ হয়ে যায়নি। ওই আন্দোলন দীক্ষা দিয়েছে অনির্বাণ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার। সেই চেতনাই জন্ম দেয় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের, যা পরিণতি লাভ করে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের মধ্য দিয়ে।

(সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE