আলাপে ব্যস্ত। মঙ্গলবার বন্ধন ব্যাঙ্কের এক বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং সংস্থার কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ। ছবি: শৌভিক দে
একটি করে নতুন শাখা প্রায় প্রতিদিন। মোট শাখার ৬৮ শতাংশই গ্রাম আর আধা শহর অঞ্চলে। ৩৩% তো আবার এমন কোথাও, যেখানে আগে ব্যাঙ্কের পা-ই পড়েনি কখনও। সঙ্গে আড়াইশো এটিএম।
বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই ৯০ লক্ষ সেভিংস অ্যাকাউন্ট। ঋণ খেলাপ নিয়ে তুমুল হইচইয়ের এই বাজারেও মোট অনুৎপাদক সম্পদ ঋণের মাত্র ০.১৬%! সপ্তাহে সাত দিন ব্যাঙ্ক খোলা রাখার অভ্যাসও দেশে প্রথম চালু হয়েছে তাদের হাত ধরে। সোজাসাপ্টা ব্যাঙ্কিং পরিষেবার পাশাপাশি তাই ‘কথা রাখা’কেও পথ চলার পুঁজি করেছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। প্রথম বছরে অন্তত এক চুলও সরে আসেনি দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন থেকে।
২০১৫ সালের ২৩ অগস্ট বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক হিসেবে যাত্রা শুরু করে বন্ধন ব্যাঙ্ক। স্বাধীনতার পরে রাজ্য তথা পূর্ব ভারতে গড়ে ওঠা প্রথম নতুন ব্যাঙ্ক হিসেবে। সে দিনই উদ্বোধনী মঞ্চে ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা তথা কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষের বার্তা ছিল, ‘‘ক্ষুদ্র-ঋণ সংস্থা থেকে ব্যাঙ্ক হওয়ার সাফল্যে ঢেকুর তোলার দিন আজই শেষ। এ বার লড়াই ‘অন্য রকম’ ব্যাঙ্ক হওয়ার।’’ মঙ্গলবার প্রতিষ্ঠানের প্রথম বর্ষপূর্তিতে তাঁর দাবি, গত ৩৬৫ দিনে লাগাতার সেই চেষ্টাই করে গিয়েছেন তাঁরা।
লাভের কড়ি গোনা অবশ্যই ব্যবসার বাধ্যবাধকতা। টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ শর্তও। কিন্তু শুধু সেটুকুকে মোক্ষ না-করে বন্ধন ব্যাঙ্কের লক্ষ্য বরং দেশে ব্যাঙ্কিং ব্যবসার প্রচলিত ছবি কিছুটা হলেও বদলে দেওয়া। আর সেই দৌড়ে একেবারে শুরুর দিনে দেওয়া ‘অন্য রকম’ ব্যাঙ্ক হওয়ার কথা রাখাই তাঁদের মূলধন বলে চন্দ্রশেখরবাবুর দাবি। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাঙ্ক সম্পর্কে অনেক সাধারণ মানুষের মনে জমে থাকা ভীতি দূর করার প্রতিজ্ঞাও। এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর এন এস বিশ্বনাথনও।
প্রথম বছরের নিরিখে বন্ধন ব্যাঙ্কের আর্থিক ফলাফল বেশ ভাল। গত বছর ২৩ অগস্ট আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরে আগের আর্থিক বছরে কার্যত ৭ মাস ৭ দিন কাজ করেছে তারা। তাতে কর দেওয়ার পরে মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৭৫.২৫ কোটি টাকা। মোট আয় ১,০৮২.৭১ কোটি। তার মধ্যে সুদ থেকে নিট আয় ৯৩২.৭২ কোটি। মোট ধার দেওয়া হয়েছে ১৫,৪৯৩.৯৭ কোটি টাকা। যদিও তার একটা ছোট্ট অংশ (১৫৬ কোটি) গিয়েছে ক্ষুদ্র-ঋণের বাইরে। এখন অবশ্য অন্য ক্ষুদ্র-ঋণ সংস্থা, ছোট ব্যবসা, বাড়ি-দু’চাকার গাড়ি-ট্রাক্টর কেনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ধার দেওয়ার উপর জোর দিচ্ছে তারা। আর আমানত জমা পড়েছে ১২,০৮৮.৭৫ কোটির। যার মধ্যে সেভিংস এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকেই এসেছে তার ১৫%। নিট সম্পদের পরিমাণ ৩,৩৪৪.৫ কোটি।
কিন্তু শুধু লাভ-ক্ষতি-ব্যবসার অঙ্কই যে এই নতুন ব্যাঙ্কের সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি নয়, তা এ দিন ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন চন্দ্রশেখরবাবু। জানিয়েছেন, উদ্বোধনের সময়ে তাঁদের শাখা ছিল ৫০১টি। এখন তা বেড়ে পৌঁছেছে ৭০১টিতে। দ্বিতীয় বছর পূর্ণ হওয়ার আগে ওই সংখ্যা অন্তত হাজারে নিয়ে যেতে চান তাঁরা। সংশ্লিষ্ট মহলের অনেকে বলছেন, সাধারণত একটি ব্যাঙ্ক চালুর পরে প্রথম ১০০-১৫০ দিন তার কাজ গোছাতেই চলে যায়। তার মানে পরের ২০০ দিনে ২০০টি শাখা খুলেছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। গড়ে দিনে একটি।
এখনও শিল্পকে সে ভাবে ঋণ দেওয়া শুরুই করেনি বন্ধন ব্যাঙ্ক। তার ব্যবসার ঘোরাফেরা মূলত ব্যক্তি-ঋণের চত্বরে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সেই চ্যালেঞ্জ সামলানোর পরীক্ষা তাদের এখনও বাকি। যদিও এ বিষয়ে চন্দ্রশেখরবাবু বলছেন, ‘‘শিল্পে মোটা ধার দেওয়া অনেক বড় ব্যাঙ্কও এখন সেখান থেকে হাত গুটিয়ে রেখেছে। তারা বরং ঝুঁকছে খুচরো ঋণের দিকে। যেখানে আমাদের ভিত ইতিমধ্যেই শক্ত। তবে আগামী দিনে ঠিক সময়ে শিল্পকে বড় ঋণ দেওয়ার দিকেও এগোব আমরা।’’
তিনি জানান, আপাতত তাঁদের লক্ষ্য, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পরিষেবা পৌঁছনো। যে-কারণে তাঁদের শাখার ৬৮% গ্রাম ও আধা শহর অঞ্চলে। তার মধ্যে ৩৩% আবার আগে কখনও ব্যাঙ্কের দরজা না-খোলা এলাকায়। ৪৫% শাখা এ রাজ্যেই। ফলে এ বিষয়ে যে-প্রতিশ্রুতি ব্যাঙ্ক দিয়েছিল, যে-কোনও মূল্যে তা পূরণ করতে তাঁরা দায়বদ্ধ বলে চন্দ্রশেখরবাবুর দাবি।
রাষ্ট্রপতি এবং তিনি দু’জনেই এ দিন বলেছেন, বন্ধন ব্যাঙ্কের জন্মই ওই প্রতিশ্রুতি থেকে। চন্দ্রশেখরবাবুর কথায়, ‘‘২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি। প্রণববাবু তখন অর্থমন্ত্রী। সেই সময়েই তিনি বলেছিলেন সকলের দরজায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা।’’
স্মৃতির সরণিতে ফিরে গিয়েছেন রাষ্ট্রপতিও। বলেছেন, তাঁর সঙ্গে চন্দ্রশেখরবাবুর আলাপ কীর্ণাহারে তাঁর নিজের গ্রামে ক্ষুদ্র-ঋণ সংস্থা হিসেবে বন্ধন শাখা খোলার সময়ে। ওই বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটেই নতুন ব্যাঙ্ক লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন প্রণববাবু। জানিয়েছেন, পরে বন্ধনের বরাতে ব্যাঙ্কিং লাইসেন্সের শিকে ছেঁড়ায় তিনি খুশি।
সারা দেশে ঋণ খেলাপের এই ভরা বাজারে বন্ধন ব্যাঙ্ক যে-ভাবে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ তলানিতে বেঁধে রেখেছে, তার প্রশংসা করেছেন প্রণববাবু। চন্দ্রশেখরবাবু জানান, এই মুহূর্তে তাঁদের মোট অনুৎপাদক সম্পদ ০.১৬%। নিট হিসেবে যা ০.০৮%। যদিও ঋণ খেলাপের মূল সমস্যা শিল্পকে ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে, যেখানে বন্ধন ব্যাঙ্কের ব্যবসা এখনও কম। আর যে-ক্ষুদ্র ও খুচরো ঋণে তাদের বেশির ভাগ টাকা যায়, সেখানে ঋণ খেলাপের সমস্যা এমনিতেই তুলনায় অনেক কম। তাই আগামী দিনে শিল্পকেও পুরোদস্তুর ধার দেওয়া শুরু করলে, তখন অনুৎপাদক সম্পদ কোথায় দাঁড়ায়, সেটাই দেখার।
অবশ্য আগামী দিনেও এই সমস্যায় রাশ কড়া রাখতে অন্তত ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চন্দ্রশেখরবাবু ‘বুঝেশুনে চলা’র নীতিতে বিশ্বাসী। গ্রাহককে ভাল ভাবে জেনে, চিনে এবং কীসের জন্য তিনি ওই টাকা নিচ্ছেন, তা বিচার করে তবেই ধার দেওয়ার পক্ষপাতী তাঁরা। তিনি মনে করেন ঝুঁকি নিতেই হবে। কিন্তু তা বলে চোখকান বুজে দুরন্ত বেগে ব্যবসা বাড়াতে গিয়ে নয়। তাঁর মতে, ‘‘ব্যাঙ্কিং স্বল্প পাল্লার দৌড় নয়। বরং ম্যারাথন।’’
আর এই ম্যারাথনে জেতার সঙ্কল্প নিয়েই প্রথম থেকে একটু অন্য রকম রাস্তায় হেঁটেছে বন্ধন ব্যাঙ্ক। যেমন, পরিষেবা প্রসারে জোর দিয়েছে পাড়ার মধ্যেও ছোট শাখা খোলার উপরে। তাদের কিছু শাখা খোলা থাকছে সপ্তাহে সাত দিনই। আর সব থেকে বেশি করে জোর দেওয়া হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও পরিষেবা সকলের দরজায় পৌঁছে দেওয়ায়। এ দিনও চন্দ্রশেখরবাবু বলেছেন, ‘‘শুধু গোয়া, কাশ্মীর এবং আন্দামান-নিকোবরে এখনও পরিষেবা চালু করতে পারিনি। শীঘ্রই শাখা খোলা হবে সেখানেও।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy