প্রতীকী ছবি।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর। সকালটা দেখে ছোট ব্যবসায়ীরা আঁচ করতে পারেননি সন্ধ্যায় কত বড় ‘ঝড়’ আসতে চলেছে। সে দিন সন্ধ্যাতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, রাত ১২টা থেকে বাতিল হয়ে যাবে পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরবর্তী কয়েক মাসে কার্যত তছনছ হয়ে যায় দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের বড় অংশের কারবার। অভিযোগ, নগদের অভাবে কাঁচামাল পেতে হিমশিম খেতে হয় তাঁদের। সমস্যায় পড়তে হয় কর্মীদের বেতন মেটাতেও। পাশাপাশি, ক্রেতাদের হাতেও নগদ না থাকায় বিপুল ভাবে ধাক্কা খায় পণ্যের চাহিদা।
নোটবন্দির এক বছরের মাথায় ব্যবসায়ীদের একাংশ জানিয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষত তখনও দগদগে। আর দু’বছরের মাথাতেও তাঁদের বক্তব্য, এই সময়ের মধ্যে ব্যবসা হারিয়ে কোনও কোনও সংস্থা পুরোপুরি ঝাঁপ বন্ধ করেছে। কেউ বা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতির মেরামতি কিছুটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আগের জায়গায় এখনও ফেরা যায়নি।
নোটবন্দির পক্ষে কেন্দ্রের যুক্তি ছিল, কালো টাকার রমরমা রুখতে ওই পদক্ষেপ। নগদের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে লেনদেনের পক্ষে সওয়াল করেছিল সরকার। ব্যবসায়ীরাও সেই সময়ে ভেবেছিলেন, প্রাথমিক ভাবে সমস্যা হলেও এতে আখেরে ভালই হবে। চৌহদ্দি স্বচ্ছ হবে ব্যবসার। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে, বাতিল নোটের প্রায় সবই ঘরে ফিরেছে। ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, তা হলে সেই কৃচ্ছ্রসাধনে লাভ কী হল?
দু’বছর আগের সন্ধ্যায় টিভিতে নোটবন্দির খবর শুনেছিলেন হুগলির সিঙ্গুরের সর্ষে ও বেসন তৈরির কারখানার মালিক স্বপন দাস ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মগরাহাটের ‘সিলভার ফিলিগ্রি’ বা রূপোর বাট থেকে গয়না তৈরির ব্যবসায় যুক্ত হাজার দুয়েক ছোট কারখানার ক্লাস্টারের চেয়ারম্যান তাপস মণ্ডল। গত বছরই নোটবন্দি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা। এ দফায় স্বপনবাবুর দাবি, তাঁদের ক্রেতা জেলার ছোট দোকানগুলি। নগদে লেনদেনই যাদের মূল ভরসা। নগদের অভাবে বাজারে চাহিদা কমায় তারাও পণ্য কেনা কমিয়ে দেয়। এখনও একলপ্তে বেশি মাল কিনছে না দোকানগুলি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হলেও যে ভাবে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, বাজারে এখনও তার লক্ষণ নেই। তাপসবাবু জানাচ্ছেন, মগরাহাটের অনেকেই কারখানা গুটিয়ে শহরে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন।
ছোট শিল্পের কারবারিদের আরও বক্তব্য, নোটবন্দির ঝাঁকুনির পরেও ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কা দেয় জিএসটি। করের হার ও রিটার্ন দাখিলের প্রক্রিয়ায় এত বার বদল হয়েছে যে, নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে দ্রুত মানাতেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে তাঁদের। ফলে অর্থনীতির পরিবর্তনের জোড়া ধাক্কায় এখনও পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ছোট শিল্প।
ছোট ও মাঝারি শিল্পের প্রতিনিধি গোবিন্দ সরাফের ওয়েল্ডিং রড তৈরির কারখানা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘নোটবন্দিতে কালো টাকা মিলল কোথায়? মাঝখান থেকে আচমকা অন্ধকার নেমে এল ছোট সংস্থাগুলির ব্যবসায়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘নগদেই আমাদের লেনদেন চলে। নোটবন্দির জন্য বাজারে নগদের জোগান কমে যাওয়ায় এক ধাক্কায় ব্যবসাও কমল অনেকটা। অন্তত কয়েক বছর পিছিয়ে গেল এই শিল্প।’’
মোটের উপর ছোট সংস্থাগুলির বড় অংশের বক্তব্য, তাদের পুঁজি কম। কম মুনাফা ও আয়ের হারও। ফলে পুঁজির জোগানও অনিয়মিত। সেই সমস্যা না মিটিয়ে নগদের বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল লেনদেনের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা কার্যত অসম্ভব। গোবিন্দবাবুর প্রশ্ন, ‘‘নোট বাতিল করে কেন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে? আর্থিক সুবিধা বা অন্য কোনও উপায়ে তো ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় জোর দিতে পারত কেন্দ্র।’’
একই পরিস্থিতি বারুইপুরে সার্জিক্যাল যন্ত্র (ছুরি, কাঁচি ইত্যাদি) তৈরির প্রায় ৬০০টি ছোট কারখানার। ক্লাস্টারের প্রেসিডেন্ট মানব নাইয়ার দাবি, নোটবন্দির পর প্রায় ছ’থেকে আট মাস বরাত পায়নি সংস্থাগুলি। সেই ধাক্কার রেশ কাটেনি এখনও।
আর তাই দীপাবলির আবহে আলোয় ফেরা তো দূর অস্ত্, ৮ নভেম্বর এলে সেই আঁধারের স্মৃতিই ফিরে আসে ছোট শিল্পের বৃত্তে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy