Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
আরবিআইয়ের সুদ স্থির করার ক্ষমতা ছাঁটতে চায় কেন্দ্র

রাজনের সঙ্গে সংঘাতের পথে জেটলি

ফের রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সংঘাতে অরুণ জেটলির অর্থ মন্ত্রক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের ডানা ছাঁটার প্রস্তাব এনে অর্থ মন্ত্রক রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আবার কুস্তির লড়াই ঘোষণা করে দিল। ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছিলই।

বিরক্তি। বৈঠকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর (বাঁ দিকে) ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।  — ফাইল চিত্র।

বিরক্তি। বৈঠকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর (বাঁ দিকে) ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। — ফাইল চিত্র।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০২:৩৪
Share: Save:

ফের রঘুরাম রাজনের সঙ্গে সংঘাতে অরুণ জেটলির অর্থ মন্ত্রক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের ডানা ছাঁটার প্রস্তাব এনে অর্থ মন্ত্রক রঘুরাম রাজনের সঙ্গে আবার কুস্তির লড়াই ঘোষণা করে দিল।

ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছিলই। নরেন্দ্র মোদী সরকারের মন্ত্রীরা নিয়মিত ঘরোয়া আলোচনায় বিষোদ্গার করছিলেন রঘুরাম রাজনের নামে। কারণ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর সুদের হার কমাচ্ছেন না। শিল্পের জন্য ঋণ সহজলভ্য না-হওয়াতেই নতুন লগ্নি হচ্ছে না। দ্রুত গতিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ছে না। সরকারের যুক্তি সেই কারণেই আসছে না ‘আচ্ছে দিন’।

এ বার অর্থ মন্ত্রক রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের ডানা ছাঁটার প্রস্তাব পেশ করায় সেই ক্ষোভই প্রকাশ্যে চলে এল। দু’দিন আগেই আর্থিক ক্ষেত্রের জন্য খসড়া বিধি প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রক। ওই বিধি চালু হলে, সুদ ঠিক করার ক্ষমতা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাত থেকে কার্যত কেন্দ্রের হাতে চলে যাবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বদলে একটি ৭ সদস্যের সুদ-নীতি কমিটি সুদ ঠিক করবে। ওই ৭ জনের মধ্যে ৪ জনকেই কেন্দ্র নিয়োগ করবে। গভর্নরের কোনও ‘ভেটো পাওয়ার’-ও থাকছে না।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীনতায় সরকার হস্তক্ষেপ করতে চাইছে বলে ইতিমধ্যেই শোরগোল শুরু হয়েছে। তবে অর্থ প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হা, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমের যুক্তি, এটা খসড়া প্রস্তাব মাত্র। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। খসড়া প্রকাশ করে সকলের মত চাওয়া হয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ বা সংশ্লিষ্ট মহল যাতে খসড়া প্রস্তাবের পক্ষেই মত দেন, তার জন্য ঘরোয়া স্তরে দরবার শুরু করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপির শীর্ষ নেতারা। তাঁদের যুক্তি, সুদ কমানো বা বাড়ানোর ক্ষমতা কোনও একজন ব্যক্তির ইচ্ছের উপর নির্ভর থাকা উচিত নয়। গভর্নরের ক্ষমতা কমিয়ে এ ক্ষেত্রে আরও গণতন্ত্র আসা প্রয়োজন। সরকারের মতামতও গুরুত্ব পাওয়া উচিত।

ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা ঘরোয়া আলোচনায় স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, এ শুধু ডানা ছাঁটার প্রস্তাব নয়। এ’টি রঘুরাম রাজনের উদ্দেশে কড়া বার্তাও। কারণ বারবার ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা পাঠানো সত্ত্বেও রাজন সুদ কমানোর রাস্তায় হাঁটছেন না। তিনি মূল্যবৃদ্ধি আরও কমার অপেক্ষায় রয়েছেন। এক ক্যাবিনেট মন্ত্রী কটাক্ষ করেন, ‘‘উনি আসলে অর্থনীতির আরও খারাপ সময়ের অপেক্ষা করছেন!’’ মন্ত্রীদের যুক্তি, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার শূন্যের নীচে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম আদৌ বাড়ছে না। কমছে। উল্টো দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের যুক্তি, খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের উপরে। এতে খাদ্যপণ্যের দাম অনেকটা বেশি গুরুত্ব পায়। এপ্রিল মাস থেকেই তা ধাপে ধাপে ধাপে বাড়ছে। তা ছাড়া শুধু মূল্যবৃদ্ধির হার দেখে সুদের হার ঠিক করা যায় না। অর্থনীতির নানা রকম মাপকাঠি, দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, সব খতিয়ে দেখে সুদের হার স্থির হয়।

বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, সরকারের হাতে সুদের হার ঠিক করার ক্ষমতা চলে গেলে স্বল্পমেয়াদি লাভের কথাই ভাবে হবে। তাতে অর্থনীতিরই ক্ষতি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তার স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে নিছক ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এ পরিণত হলে কিন্তু আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও ভুল বার্তা যাবে। সরকারের হাতে ক্ষমতা গেলে সুদের হার ঠিক হবে রাজনৈতিক লাভের দিকে তাকিয়ে।

তবে মন্ত্রীদের যুক্তি, সুদ-নীতি সংক্রান্ত কমিটিতে সরকারের লোক থাকলে তাদের আর্থিক ও সুদ -নীতির মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় থাকবে।

মন্ত্রীরা বলছেন, ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো দেশে সুদ-নীতি সংক্রান্ত কমিটিই সুদের হার ঠিক করে। বিশেষজ্ঞদের পাল্টা যুক্তি, ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডের কমিটিতে ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমেরিকার কমিটিতে আইনসভার প্রতিনিধিরা কমিটিতে যথেষ্ট দীর্ঘ সময় থাকেন। ফলে তাঁরা স্বল্পমেয়াদি লাভের কথা ভাবেন না।

অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সংঘাত এ দেশে নতুন নয়। ইউপিএ-জমানায় পি চিদম্বরমের সঙ্গেও তদানীন্তন গভর্নর ডি সুব্বারাওয়ের এই সুদ কমানো নিয়েই সংঘাত চরমে উঠেছিল। চিদম্বরম প্রকাশ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কঠোর সুদ নীতির সমালোচনা করেছিলেন। অরুণ জেটলি প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি বটে। কিন্তু কাগজে-কলমে সংঘাত চলছে।

সুদ নির্ধারণের ক্ষমতা ছাঁটার আগে সরকারি ঋণপত্রের (গভর্নমেন্ট ডেট) নিয়ন্ত্রণ সেবি-র হাতে তুলে দিয়ে চেয়েছিলেন জেটলি। কেন্দ্রের ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও দেখভালের জন্য পৃথক সংস্থা তৈরির কথাও ঘোষণা করেন। কিন্তু বিভিন্ন মহলে ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফেও আপত্তি ওঠায় দু’টি প্রস্তাবই হিমঘরে পাঠান তিনি। লড়াইয়ের প্রথম রাউন্ড এগিয়ে থেকেই শেষ করলেও এ বার দ্বিতীয় রাউন্ডেও জেটলি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। সুদ কমানো-বাড়ানোকেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের সবথেকে বড় ক্ষমতা হিসেবে ধরা হয়। এ বিষয়ে তিনি ব্যাঙ্কের উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ নিতে পারেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁরই হাতে। সেই ক্ষমতাতেই হাত দিতে চাইছে অর্থ মন্ত্রক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE