Advertisement
০৭ মে ২০২৪

উইকেট বাঁচিয়ে

কর বাঁচাতে অর্থবর্ষের শেষ দু’মাসে লগ্নির টি-টোয়েন্টি তো আছেই। তবে আয়করের বাউন্সার সামলাতে হবে লম্বা জীবনের টেস্ট ম্যাচেও। দিশা দেখালেন অমিতাভ গুহ সরকারকর বাঁচাতে অর্থবর্ষের শেষ দু’মাসে লগ্নির টি-টোয়েন্টি তো আছেই। তবে আয়করের বাউন্সার সামলাতে হবে লম্বা জীবনের টেস্ট ম্যাচেও।

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৬
Share: Save:

অর্থবর্ষের শেষ দিকে মরিয়া লগ্নি। তার পরে জুলাইয়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল। শেষ মুহূর্তে আয়কর বাঁচাতে এত হুড়োহুড়ির প্রয়োজনই পড়ে না, যদি শুরু থেকে বিষয়টিকে কিছুটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা যায়। গত সপ্তাহে এ বিষয়েই আলোচনা করেছিলাম।

কিন্তু এর বাইরেও রয়েছে জীবনের লম্বা টেস্ট ম্যাচ। সেখানেও উইকেটে টিকে থাকতে সামলাতে হয় করের বাউন্সার। সেই তালিকায় শেয়ার, ফান্ড, বিমার পাশাপাশি আছে সম্পত্তি, দান, এমনকি অবসর কিংবা স্বেচ্ছাবসরের সময়ে পাওয়া অর্থের উপর প্রযুক্ত করও। এগুলির সংশ্লিষ্ট ধারা এবং কর বাঁচানোর সুযোগ নিয়েই আজকের আলোচনা।

শেয়ার ও ইকুইটি ফান্ডে লগ্নি

• এক বছর ধরে রাখলে শেয়ার ও শেয়ার নির্ভর ফান্ডের ইউনিট বেচে মুনাফা (মূলধনী লাভ) হলে এত দিন কর দিতে হত না। চলতি অর্থবর্ষ থেকে নিয়ম হয়েছে, বছরে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত এই ধরনের লাভ করমুক্ত।

• মূলধনী লাভ ১ লক্ষ ছাড়ালে তার উপরে কর গুনতে হবে ১০% হারে।

• এক বছরের মধ্যে ইকুইটি শেয়ার বিক্রি করে মুনাফা করলে, তার উপরে ১৫% হারে ধার্য হবে কর।

শেয়ার থেকে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ড

শেয়ার থেকে প্রাপ্ত ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড নিয়ে চিন্তা নেই। পুরোটাই করমুক্ত। ডিভিডেন্ড ১০ লক্ষ ছাড়ালে তার উপরে কর ১০%।

ফান্ড থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড

• ইকুইটি ফান্ড থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ডে ১০% হারে ডিভিডেন্ড বণ্টন কর চালু হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষ থেকেই। তাই খুব প্রয়োজন না থাকলে ডিভিডেন্ডের বদলে বৃদ্ধি বা গ্রোথ বিকল্প বেছে নেওয়াই ভাল।

• ঋণপত্র নির্ভর ফান্ড (ডেট ফান্ড) থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ডে কর দিতে হয় না। তবে ফান্ডকে ২৯.১২% হারে গুনতে হয় আয় বণ্টন কর।

ঋণপত্র ফান্ড বিক্রি বাবদ লাভ

• ডেট ফান্ডের লগ্নি ৩ বছর ধরে রেখে বিক্রি করলে, হাতে আসা মুনাফা দীর্ঘকালীন মূলধনী। যার উপরে মূল্যবৃদ্ধি সূচক (কস্ট ইনফ্লেশন ইনডেক্স) প্রয়োগ করে লাভের অঙ্ককে অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। বাকি অংশের উপরে কর দিতে হয় ২০%।

• তিন বছরের আগে এই ফান্ড ভাঙিয়ে মুনাফা হলে তা যোগ হবে লগ্নিকারীর অন্যান্য আয়ের সঙ্গে। তার পরে কর দিতে হবে প্রযোজ্য হারে।

বন্ড থেকে প্রাপ্ত সুদ

করমুক্ত বন্ড ছাড়া বাকি সমস্ত বন্ড এবং ডিবেঞ্চারের সুদ অন্যান্য আয়ের মতোই করযোগ্য। কয়েক বছর হল, করমুক্ত বন্ড আর ইসু করা হচ্ছে না। তবে তা ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে শেয়ার বাজার থেকে কেনা যায়।

মেয়াদ শেষে প্রাপ্ত বিমার অঙ্ক

• ২০০৩ সালের আগে পর্যন্ত মেয়াদ শেষে বা পলিসি সারেন্ডার করলে যে টাকা পাওয়া যেত, তা ছিল করমুক্ত। ২০০৩ সালের বাজেটে নিয়ম হয়, যে সব পলিসির বাৎসরিক প্রিমিয়াম পলিসি মূল্যের ২০ শতাংশের বেশি নয়, সেগুলিতেই মিলবে এই সুবিধা।

• আবার ২০১২ সালের ১ এপ্রিলের পরে কেনা যে সমস্ত পলিসির বাৎসরিক প্রিমিয়াম পলিসি মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি নয়, সেগুলিতে এই ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়।

কৃষি থেকে আয়

ভারতে কৃষিজমি থেকে প্রাপ্ত আয় করমুক্ত। এই আয়ের মধ্যে পড়ে—

• জমি থেকে প্রাপ্ত ভাড়া

• কৃষিজাত পণ্য থেকে আয়

• কৃষিজমিতে তৈরি বাড়ি থেকে আয়

গৃহঋণ বাবদ কর সাশ্রয়

• গৃহঋণের আসল শোধ বাবদ বছরে ১.৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অঙ্কের উপরে ৮০সি ধারায় পাওয়া যায় কর ছাড়।

• ২৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, গৃহঋণের সুদে ২ লক্ষ পর্যন্ত কর ছাড়ের সুবিধা মেলে। দ্বিতীয় বাড়ির জন্য নেওয়া ঋণের সুদে এই ঊর্ধ্বসীমা নেই।

অংশীদারি কারবারে লাভ

অংশীদারি কারবার থেকে প্রাপ্ত মুনাফার উপরে অংশীদারকে আলাদা করে কর দিতে হয় না। কারণ কর ধার্য হয় পার্টনারশিপ ফার্মের উপরে।

পেনশন তহবিল

• অবসরের সময়ে পেনশনের একাংশ কমিউট করে সরকারি কর্মীরা যে অর্থ পান, তার পুরোটাই করমুক্ত। অন্যদের ক্ষেত্রে—

• অবসরের সময়ে কোনও কর্মী যদি গ্র্যাচুইটি পান, সে ক্ষেত্রে তিনি প্রাপ্য পেনশন তহবিলের এক-তৃতীয়াংশ করমুক্ত অবস্থায় পেতে পারেন।

• যাঁরা গ্র্যাচুইটি পান না, তাঁরা কর ছাড় পেতে পারেন পেনশন তহবিলের ৫০% পর্যন্ত নেওয়া (কমিউট) অঙ্কের উপর।

• মাসিক পেনশন বেতনের মতোই করযোগ্য।

ছুটি বিক্রি

সরকারি কর্মীরা অবসরের সময়ে নিয়ম অনুযায়ী ছুটি বিক্রি করলে তার পুরোটাই থাকে করমুক্ত। অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মীরাও নির্দিষ্ট শর্তে এই সুবিধা পেয়ে থাকেন। নীচের তালিকা অনুযায়ী যেটি ন্যূনতম, সেটির ক্ষেত্রে কর ছাড়ের সুবিধা পান সংশ্লিষ্ট কর্মী।

• ছুটি বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত অঙ্ক।

• জমে থাকা অর্জিত ছুটিকে গড় মাসিক বেতন দিয়ে গুণ করলে যা দাঁড়ায়।

• ১০ মাসের গড় বেতন (বেসিক + ডিএ)।

• ৩ লক্ষ টাকা।

স্বেচ্ছা অবসরজনিত আয়

এ ক্ষেত্রেও নীচের তালিকা অনুযায়ী যেটি সব থেকে কম, সেই পর্যন্ত মেলে কর ছাড়ের সুবিধা।

• অতীতে কাজ করা প্রতিটি পূর্ণ বছর পিছু তিন মাসের বেতন।

• যে ক’মাসের কাজ বাকি আছে তাকে শেষ বেতন দিয়ে গুণ করলে যে অঙ্ক দাঁড়ায়।

• ৫ লক্ষ টাকা।

দান ও উপহার

দানের উপরে করের বিষয়টি নির্ধারিত হয় আয়কর আইনের ৫৬ (২) ধারা অনুযায়ী।

• এক জন ব্যক্তি যে দান গ্রহণ করতে পারেন, তার মধ্যে থাকতে পারে অর্থ, সম্পত্তি, গয়না, লগ্নিপত্র ইত্যাদি।

• বছরে মোট ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের প্রাপ্ত দান থাকে পুরোপুরি করমুক্ত। প্রাপ্ত দান যদি ৫০,০০০ টাকার বেশি হয়, তা হলে তার পুরোটাই অন্যান্য সূত্রের আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং তার উপরে প্রযোজ্য হারে কর বসে।

• কেউ যদি প্রতিদান ছাড়া বা কম প্রতিদানের বিনিময়ে আত্মীয়ের থেকে অর্থ অথবা সম্পত্তি দান হিসেবে পেয়ে থাকেন, তবে তার পুরোটাই করমুক্ত থাকবে, মূল্য যা-ই হোক। সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী ‘আত্মীয়’ বলতে আমরা যাঁদের বুঝব, তাঁরা হলেন— (১) স্বামী-স্ত্রী (২) ভাই ও বোন (৩) স্বামী অথবা স্ত্রীয়ের ভাই ও বোন (৪) বাবা এবং মায়ের ভাই ও বোন (৫) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সরাসরি উপরের অথবা নীচের দিকের কোনও আত্মীয় (৬) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বামী/স্ত্রীয়ের সরাসরি উপরের অথবা নীচের কোনও আত্মীয় (৭) উপরে বলা দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ ব্যক্তির স্বামী অথবা স্ত্রী।

প্রশ্ন হল, বিয়ের সময়ে অনেকেই তো অঢেল উপহার পেয়ে থাকেন এবং তার অনেকটাই আত্মীয় নন এমন মানুষদের থেকে! সুখের কথা, বিয়ে উপলক্ষে প্রাপ্ত দান বা উপহারের উপরে কোনও কর দিতে হয় না। অর্থাৎ বিয়েকে কেন্দ্র করে যত খুশি করমুক্ত দান গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে এর যাবতীয় তথ্য সযত্নে রক্ষা করতে হবে। একই ভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে বা কোনও ব্যক্তির উইল অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্পত্তি পুরোপুরি থাকে করের আওতার বাইরে। এ ছাড়া—

• শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত স্কলারশিপের উপরে কোনও কর দিতে হয় না। সে প্রতিষ্ঠান সরকারি অথবা বেসরকারি, যা-ই হোক না কেন।

• করমুক্ত থাকে পুরসভা বা লোকাল অথরিটি থেকে প্রাপ্ত অনুদানও [ধারা ১০ (২০)]।

• আয়কর আইনের ১২এএ ধারায় স্বীকৃত কোনও ট্রাস্ট বা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুদানের উপরেও কর দিতে হয় না।

দানের মাধ্যমে কর সাশ্রয়

কাছের কোনও আত্মীয়, যাঁদের দান করলে সেই দানের উপরে কর বসে না, এবং যাঁদের করযোগ্য তেমন আয় নেই, তাঁদের অর্থসম্পত্তি দান করে কর সাশ্রয় করা যেতে পারে। যেমন অবসরপ্রাপ্ত মা-বাবা এবং প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের যদি তেমন আয় না থাকে, তা হলে লগ্নিযোগ্য তহবিলের একাংশ তাঁদের দান করা যেতে পারে। এতে দাতার উপরে করের চাপ কমে।

গ্রহীতার যেহেতু তেমন করযোগ্য আয় নেই, প্রাপ্ত টাকা লগ্নি করে তাঁর যে আয় হবে, তার উপরে হয় কোনও কর দিতে হবে না, অথবা দিতে হবে অপেক্ষাকৃত কম হারে। কর পরিকল্পনা করার সময়ে, বিশেষ করে অবসর নেওয়ার সময়ে এই ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। স্ত্রী বা স্বামীকেও দান করতে বাধা নেই। তবে যদি আয়কর আধিকারিক মনে করেন, ওই দান করা হয়েছে কর কমানোর উদ্দেশ্যে, তবে তিনি প্রয়োজন মনে করলে ওই দানের অর্থ লগ্নি করে যে আয় (যেমন সুদ) হয়েছে, তাকে সংশ্লিষ্ট দাতার আয়ের সঙ্গে যুক্ত (ক্লাবিং) করে, তার উপরে প্রযোজ্য হারে কর ধার্য করতে পারেন।

উৎসমূলে কর (টিডিএস)

কোনও কোনও ক্ষেত্রে টাকা দেওয়ার সময়ে উৎসমূলে নির্ধারিত হারে কর কেটে, তা সরকারের ঘরে জমা করার দায়িত্ব বর্তায় ব্যক্তিগত করদাতাদের উপরেও। যেমন—

• বাড়ি ভাড়া মাসে ৫০,০০০ টাকার বেশি হলে, তা থেকে উৎসে ৫% কেটে আয়কর দফতরে জমা করতে হবে।

• কোনও সম্পত্তি যদি ৫০ লক্ষ টাকার বেশি দামে বিক্রি করা হয়, তবে দাম মেটানোর সময় ক্রেতা তার থেকে ১% কেটে সরকারের ঘরে জমা করবেন।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Business Income Tax
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE