অর্থনীতির আয়তন মাপার পদ্ধতি বদলে যাওয়ার পরে চলতি আর্থিক বছরে ৭.৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি আশা করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার, গত বছর যা ছিল ৬.৯ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ ছিল বলেও আজ ঘোষণা করেছে পরিসংখ্যান দফতর।
এত দিন উৎপাদনের খরচের ভিত্তিতে বার করা দেশের আয় বা জিডিপি-র ভিত্তিতে আর্থিক বৃদ্ধির হিসেব-নিকেশ করা হত। এ বার বাজার দরের ভিত্তিতে এই গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি-র পরিসংখ্যান কাজে লাগিয়ে সেই হিসেব কষা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক স্তরেও এই ভাবেই হিসেব কষা হয়। অর্থনীতির যে-সব ক্ষেত্র এত দিন হিসেবের মধ্যে আসত না, এখন সেগুলিও যোগ হয়েছে। একই সঙ্গে ২০০৪-’০৫-এর বাজার দরের বদলে এখন ২০১১-’১২-র বাজার দরের নিক্তিতে জিডিপি মাপা হচ্ছে।
আজকের পরে নরেন্দ্র মোদী সরকার বড়াই করে বলতেই পারে, এই পূর্বাভাস অনুযায়ী আর্থিক বৃদ্ধির হিসেবে ভারত এখন বিশ্ব সেরা। চিনের থেকেও বেশি। কারণ চিনের আর্থিক বৃদ্ধির হার ৭.৩%। সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অর্গানাইজেশন (সিএসও)-এর ডিজি আশিস কুমার অবশ্য সাবধানবাণী শুনিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, চিনের সঙ্গে ভারতের অর্থনীতির তুলনা হয় না। কারণ চিনের অর্থনীতির আয়তন ভারতের তিন থেকে চার গুণ। দু’দেশের বৃদ্ধির হার এই পর্যায়ে থাকলেও চিনের এই আয়তন ছুঁতে ভারতের ২০ থেকে ৩০ বছর সময় লাগবে।
গত বছর, ২০১৩-’১৪ সালের ৬.৯ শতাংশের তুলনায় এ বছর অর্থাৎ ২০১৪-’১৫ সালের ৭.৪ শতাংশ আর্থিক বৃদ্ধির হার দেখে অর্থনীতির ছবিটা আপাত ভাবে উজ্জ্বল হলে মনে হলেও, সব ক্ষেত্রেই তা নয় বলে আশঙ্কা শিল্পমহলেরও। কারণ কৃষি, খনি এবং ব্যবসা-হোটেল-পরিবহণ-যোগাযোগের মতো পরিষেবা ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় কমেছে। দেশের বাজারে কেনাবেচা এবং বিনিয়োগ, দু’টিই বেড়েছে। কিন্তু নতুন মূলধন লগ্নির ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার এখনও মাত্র ১.৩ শতাংশ। যাকে চাঙ্গা করার জন্য আগামী বাজেটে অরুণ জেটলিকে সঠিক দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করছেন বণিকসভা সিআইআই-এর ডিজি চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অর্থনীতিতে চাহিদা তেমন বাড়েনি বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ফিকি প্রেসিডেন্ট জ্যোৎস্না সুরি-ও। তাঁরও আশা, আসন্ন বাজেটে কেন্দ্র ব্যবস্থা নিলে তবেই নতুন লগ্নিতে উৎসাহ পাবে শিল্প।
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি অবশ্য আজ অর্থ মন্ত্রকের সংসদীয় উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে যুক্তি দিয়েছেন, “বিনিয়োগকারীরা যথেষ্ট উৎসাহ দেখাচ্ছেন। সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির ছবিটাও এখন যথেষ্ট ভাল।” শিল্পমহলের যুক্তি অবশ্য অমূলক নয়। সামগ্রিক ভাবে চলতি অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার ৭.৪% হলেও কৃষি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার মাত্র ১.১% থাকবে বলে সিএসও-র পূর্বাভাস। গত কালই নীতি আয়োগের বৈঠকে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর রাস্তা খোঁজার জন্য রাজ্যগুলিকে পৃথক টাস্ক ফোর্স তৈরির কথা বলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। কৃষি ছাড়াও খনিতে ২.৩%, হোটেল-পরিবহণ-যোগাযোগ ক্ষেত্রে ৮.৪ শতাংশের বৃদ্ধির হারও গত বছরের তুলনায় কম। গত বছরে এই তিনটি ক্ষেত্রে বৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৩.৭%, ৫.৪% এবং ১১.১%। কারখানার উৎপাদনে ৬.৮% বৃদ্ধির হার গত অর্থবর্ষের ৫.৩ শতাংশের তুলনায় সামান্য বেশি।
অন্য দিকে, বর্তমান বাজার দর ধরে অর্থ বছরে বৃদ্ধির পূর্বাভাস ১১.৫ শতাংশ। গত বছরের হার ১৩.৬ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.২ থেকে ৩.৮ শতাংশে নেমে আসার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী সরকার শপথ নিয়েছিল মে মাসে। সিএসও-র হিসেব অনুযায়ী, অর্থ বছরের প্রথম তিন মাস, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫%। পরের তিন মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮.২%। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে তা আবার কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, কৃষি, খনি, কারখানার উৎপাদন, নির্মাণ, হোটেল, পরিবহণ, যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার বছরের শুরুর তুলনায় ক্রমশ কমেছে। বেড়েছে একমাত্র আর্থিক ক্ষেত্র, রিয়েল এস্টেট এবং পেশাদার পরিষেবায়। চোখে পড়ার মতো হারে বেড়েছে সরকারি ব্যয়। অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে সরকারি খরচ বেড়েছিল ১.৯% হারে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে সরকারি খরচ বেড়েছে ২০%। যার থেকে স্পষ্ট, সরকারি খরচ বাড়ার ফলেই বৃদ্ধির হার চাঙ্গা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, অর্থবর্ষের শেষ তিন মাসে কি একই হারে সরকার খরচ করে যেতে পারবে, না কি রাজকোষ ঘাটতিকে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখতে খরচে কাটছাঁট করতে হবে?
অর্থনীতিবিদদের একাংশ মনে করছেন, জিডিপি মাপার নতুন হিসেবের ফলে অর্থমন্ত্রী জেটলির পক্ষে রাজকোষ ঘাটতিকে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখা সহজ হতে পারে। জেটলি রাজকোষ ঘাটতিকে জিডিপি-র ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। এখন নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি-র পরিমাণ বাড়লে ৪.১ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়াও সহজ হওয়ার কথা। কিন্তু সিএসও-র কর্তারা বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে জিডিপি-র পরিমাণ এ বছরে ১২৬.৫৪ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছবে। পুরনো হিসেবের তুলনায় যা প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা কম। ফলে জিডিপি-র তুলনায় রাজকোষ ঘাটতির হিসেবেও খুব বেশি হেরফের হবে না, বরং তা ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখা কঠিনই হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy