Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আসল গোবিন্দভোগে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন

স্বাদে-গন্ধে ম-ম করা আসল গোবিন্দভোগের বাজার বাড়াতে চাইছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পরীক্ষামূলক ভাবে ইতিমধ্যেই কিছু প্যাকেট বাজারে ছাড়া হয়েছে। উচ্চ মানের গোবিন্দভোগ চাষ ছড়িয়ে দিতে ২০০৯ সালে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুগন্ধি চাল বিশেষজ্ঞ মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের তত্ত্বাবধানে নদিয়ার হরিণঘাটা, চাকদহ ও রানাঘাটে ১৩৪ বিঘা জমিতে ৭৮ জন চাষ শুরু করেন।

বিতান ভট্টাচার্য
হরিণঘাটা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:১৮
Share: Save:

স্বাদে-গন্ধে ম-ম করা আসল গোবিন্দভোগের বাজার বাড়াতে চাইছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পরীক্ষামূলক ভাবে ইতিমধ্যেই কিছু প্যাকেট বাজারে ছাড়া হয়েছে।

উচ্চ মানের গোবিন্দভোগ চাষ ছড়িয়ে দিতে ২০০৯ সালে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুগন্ধি চাল বিশেষজ্ঞ মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের তত্ত্বাবধানে নদিয়ার হরিণঘাটা, চাকদহ ও রানাঘাটে ১৩৪ বিঘা জমিতে ৭৮ জন চাষ শুরু করেন। গত পাঁচ বছরে বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ২৯টি ব্লকে ১৩৬০ বিঘা জমিতে প্রায় এগারোশো কৃষক এই চাষ করছে। তবে আবহাওয়া ও উপযুক্ত জমির দৌলতে বর্ধমানই সব চেয়ে এগিয়ে।

গোবিন্দভোগ আগে চাষ হত বিক্ষিপ্ত ভাবে। বিপণন ছিল পাইকার ও কিছু বাণিজ্যিক সংস্থার দখলে। তাতে মান বজায় থাকছিল না। এখন কৃষি বিপণন দফতর সরকারি প্যাকেটে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে গোবিন্দভোগ বিক্রি করছে। রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, “অন্য সুগন্ধি চালের সঙ্গে আসল গোবিন্দভোগ মিশে যাচ্ছিল। বাঙালির নস্টালজিয়ার পুনরুজ্জীবন ঘটল। এর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাজারজাত করাটাই চ্যালেঞ্জ।”

বিশেষত দক্ষিণ ভারতে, এমনকী দেশের বাইরেও বহু জায়গায় গোবিন্দভোগের বিপুল চাহিদা আছে। তার মধ্যে ইউরোপ যেমন আছে, পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশও রয়েছে। কিন্তু উৎপাদিত চালের মান রফতানির যোগ্য কি? মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলেন, “গুণগত মান বজায় রাখতে জেলায়-জেলায় বিভিন্ন কৃষি সমবায় ও কৃষক সঙ্ঘগুলিকে একত্রিত করেছি। বীজ, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করছি। উৎপন্ন ফসলের ভাল বাজার থাকায় চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে।” পাঁচ বছরে আটটি জেলার ৩৫টি সমবায় ও সঙ্ঘ গোবিন্দভোগ চাষে উৎসাহী হয়েছে। রাজ্যের কৃষি সমবায় দফতরের আওতাভুক্ত হয়েছে ১৭টি। এখনও বর্ধমানের ১১টি ধানকলেই চাল তৈরির বরাত বেশি। এমনই একটি কলের মালিক অজয় রুদ্র যোগ করেন, “এখন অন্য জেলা থেকেও গোবিন্দভোগ চাল তৈরির বরাত আসছে। আশার কথা।”

২০০৯-এই লোকসভার আমদানি রফতানি নিয়ন্ত্রক কমিটি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোবিন্দভোগের পেটেন্ট অনুমোদন করে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা অনুমোদন হয়। এর পরেই বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্যাকেজিং বিভাগ’ খোলে। ছোট একটি ধানকলও গড়া হয়। মোহনপুরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই কৃষি সম্প্রসারণ বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্যাকেটে গোবিন্দভোগ বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রির টাকা সবই পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চাষি। মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় চাষিদের পথ দেখায়, ব্যবসা করে না। সরকার চাষিদের ধান কেনে। এর সঙ্গে বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠী যুক্ত। কৃষি সমবায় দফতরের কাউন্টার থেকেও চাল বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন কৃষি মেলায় যায়। পাঁচ বছরে চাহিদা অনেক বেড়েছে। আরও বাড়বে।”

চাষিরা জানান, গোবিন্দভোগের সঙ্গে মাঝারি ও ছোট দানার সুগন্ধি চাল মিলিয়ে আগে বাজারে ৩২ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হত। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৌলতে তার বদলে উচ্চ মানের গোবিন্দভোগ বাজারে মিলছে। এই মরসুমে হেক্টর প্রতি গড়ে আড়াই-তিন টন ধান উপাদন হয়েছে। কাউন্টার থেকে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে তা বিক্রিও হয়েছে। যদিও বহু চাষিই এখনও উচ্চফলনশীল স্বর্ণ, জয়া, রত্না বা আই আর-৩৬ ধান চাষ ছেড়ে গোবিন্দভোগ চাষ করার সাহস দেখাননি। নদিয়ার অসীম তালুকদার, পূর্ব মেদিনীপুরের অনন্ত মাইতি বা বর্ধমানের সমর ঘোষের মতো প্রবীণ চাষিদের আশঙ্কা, “গোবিন্দভোগের মতো সংবেদনশীল ধান চাষ করতে গিয়ে প্রকৃতির হাতে মার খেলে গরিব চাষিরা উঠে দাঁড়াতে পারবে না!”

এই ঝুঁকি সত্ত্বেও গোবিন্দভোগ যে সাধারণ ধানের চেয়ে বেশি লাভদায়ক, সেটাই এখন চাষিদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কৌশিক ব্রহ্মচারীর আক্ষেপ, “গোবিন্দভোগের যে বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব, তা চাষিদের বোঝানোই হয়নি! অথচ নদিয়ায় তো পড়ে থাকা জমিতে গোবিন্দভোগ হচ্ছে।” ২০১০ থেকে নদিয়ার তিনটি খামারে জৈব চাষের জমি তৈরি হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলেন, “এ বছর প্রথম ভেষজ গোবিন্দভোগ বাজারজাত হবে। প্যাকেজিং সংক্রান্ত অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। চাষিরা দেশের বাইরেও বড় বাজার পাবেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE