মনমোহিনী অনুদান দিয়ে নয়, কড়া দাওয়াই দিয়ে যাত্রা শুরু করল মোদী সরকার।
চড়া হারে রেল ভাড়া এবং পণ্য মাসুল বৃদ্ধি এনডিএ সরকারের প্রথম বড় সিদ্ধান্ত, যা বেশ তেতো ঠেকছে শিল্প, শেয়ার বাজার এবং সাধারণ মানুষের কাছে। রেল বাজেট এবং মূল কেন্দ্রীয় বাজেটের মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে সরকারের এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়াকে কেন্দ্র করে বিতর্ক শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।
একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, যথেষ্ট যুক্তি এবং কৌশল আছে এই সিদ্ধান্তের পিছনে। এগুলি হল: এক, ভাড়া বৃদ্ধির এই প্রস্তাব ইউপিএ সরকারের। নির্বাচনের কারণে তা মে মাসে কার্যকর করা যায়নি। অর্থাৎ খানিকটা হলেও দায় আগের সরকারের উপর চাপানো যাচ্ছে। দুই, চতুর্দিকে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও বহু দিন রেল ভাড়া তেমন বাড়ানো হয়নি। পাহাড়-প্রমাণ ঘাটতি নিয়ে যাত্রী পরিষেবা এবং সুরক্ষা আর দেওয়া সম্ভব নয়। তৃতীয় কারণটি সম্ভবত একটি কৌশল। ভাড়া বাড়িয়ে ঘাটতি না-কমালে মূল বাজেটে রেলের জন্য একটি বড় অঙ্ক বরাদ্দ করতে হত। এর ফলে প্রত্যক্ষ কর বাবদ খুব বেশি কিছু করছাড় দেওয়া সম্ভব হত না। অর্থাৎ বাজেটে আম-আদমির জন্য কিছু ভাল খবরের ব্যবস্থা করার জন্য কড়া দাওয়াইটি আগেভাগেই দিয়ে রাখা হল।
এই কারণে রেলমন্ত্রীর পক্ষে যুক্তি দেখাতে এগিয়ে এসেছেন স্বয়ং অর্থমন্ত্রী। রেলের বিপুল ঘাটতি যদি কেন্দ্রীয় বাজেটে মেটাতে হত, তবে তা-ও কিন্তু করের মাধ্যমেই তোলা হত সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই। সরাসরি রেল ভাড়া বৃদ্ধিতে দায় চাপল সেই সব মানুষের উপরে যাঁরা রেল পরিষেবা ব্যবহার করেন। সর্বসাধারণের উপরে নয়।
যাত্রী ভাড়া এবং পণ্য মাসুল এক ধাপে এতটা বাড়ানোর পক্ষে-বিপক্ষে বহু কথা বলা হলেও একটি ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে, এর ফলে পণ্যমূল্য বাড়বে, চড়বে মূল্যবৃদ্ধি, ক্ষীণ হবে সুদ কমার সম্ভাবনা। অর্থাৎ রেল নিয়ে সিদ্ধান্ত ভাল রকম আঘাত করতে পারে শেয়ার সূচককে, যা আরও উপরে যাওয়ার জন্য কোমর বাঁধছিল।
পণ্য মাসুল ৬.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে আঘাত পাবে যে-ধরনের শিল্প, তার মধ্যে রয়েছে: ইস্পাত, কয়লা, সিমেন্ট ইত্যাদির মতো মূল ভারী শিল্প। মাসুল ৬.৫ শতাংশ বাড়ায় ইস্পাতের দাম টন প্রতি বাড়তে পারে ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। সিমেন্টের দামও বাড়তে পারে ব্যাগ পিছু ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা। এই বাড়তি দামের বোঝা কিন্তু বইতে হবে সাধারণ মানুষকেই। কিছুটা ব্যাকফুটে যাবে সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলিও। এর প্রতিকূল প্রভাব শেয়ার বাজারের উপর কতটা পড়ে, তা সোমবারই কিছুটা স্পষ্ট হবে।
রেল মন্ত্রকের এই সিদ্ধান্তের ঠিক আগের দিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার ভাল প্রভাব বাজারের উপর পড়ার কথা ছিল। তা কিন্তু আর হতে পারল না। সেবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকার কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ভবিষ্যতে ৭৫ শতাংশের বেশিশেয়ার রাখতে পারবে না। অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করে ফেলতে হবে আগামী তিনবছরের মধ্যেই।
যে-সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় সরকারি মালিকানা ৭৫ শতাংশের বেশি আছে, তার মধ্যে রয়েছে: কোল ইন্ডিয়া (সরকারি মালিকানা ৮৯.৬ শতাংশ), হিন্দুস্তান কপার, এমএমটিসি এবং নেভেলি লিগনাইট (৯০ শতাংশ করে), সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক (৮৮.৬ এবং ৮৮ শতাংশ), স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া এবং এনএমডিসি (৮০ শতাংশ)।
শেয়ার বাজার এবং কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ের কাছেই এটি একটি খুশির খবর। বর্তমান দামে শুধু কোল ইন্ডিয়ার অতিরিক্ত শেয়ার বিক্রি করেই সরকার পেতে পারে কম-বেশি ৩৫,০০০ কোটি টাকা।
নতুন ইস্যুর বাজারকে ফের চাঙ্গা করার দাওয়াইও আছে সেবির সিদ্ধান্তে। সরকার এবং উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বাজারে যে-শেয়ার বিক্রি করা হবে (অফার ফর সেল) তার ১০ শতাংশ শেয়ার এ বার থেকে সংরক্ষিত থাকবে খুচরো লগ্নিকারীদের জন্য। উদ্দেশ্য, ছোট বিনিয়োগকারীদের সুবিধা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বাজারে ফিরিয়ে আনা।
বহু বছর যাবৎ লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকা ৭টি বড় প্রকল্পকে অবশেষে অনুমোদন দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। প্রকল্পগুলিতে মোট লগ্নির পরিমাণ ২১,০০০ কোটি টাকা। শিল্প এবং শেয়ার বাজারের জন্য এটিও একটি ভাল খবর।
জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদে শুরু হবে বাজেট অধিবেশন। তবে ঠিক কবে রেল এবং কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করা হবে, তার তারিখ এখনও জানানো হয়নি। জুলাই মাসের মধ্যেই বাজেট পাশ করাতে হবে, কারণ পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের পাশ করানো ভোট-অন-অ্যাকাউন্টের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ জুলাই।
গত সপ্তাহের শেষ দিকটা বাজার ম্লান ছিল ইরাক সঙ্কটের কারণে। ইরাক থেকে অশোধিত তেলের জোগানে টান পড়ার আশঙ্কা ছায়া ফেলে শেয়ার বাজারে। আশা ছিল, এই সঙ্কট কিছুটা মিটলেই বাজার আবার লাফিয়ে বাড়বে। এখন কিন্তু মনে হচ্ছে, ইরাকের তেল এবং ভারতের রেল দুইয়ে মিলে হয়তো বাজারকে আরও টেনে নামাবে।
শেয়ার বাজার দুর্বল হয়ে পড়ায় ভারতীয় টাকার তুলনায় কিছুটা শক্তি ফিরে পেয়েছে মার্কিন ডলার। আবার তা ছাড়িয়েছে ৬০ টাকার মাত্রা। এতে চাঙ্গা হচ্ছে রফতানি নির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার শেয়ারগুলি। সোমবার ইস্পাত, সিমেন্ট-সহ বেশ কয়েকটি শিল্প সংস্থার শেয়ারের দাম পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এত সব ঘটনা সত্ত্বেও বাজারের নজর কিন্তু নিবদ্ধ থাকবে মূল কেন্দ্রীয় বাজেটের দিকেই। বাজেট পেশ হওয়ার পাশাপাশি প্রকাশিত হতে শুরু করবে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের কোম্পানি ফলাফল। নজর থাকবে বর্ষার গতিপ্রকৃতির উপরেও। অর্থাৎ বেশ ঘটনাবহুল হবে জুলাই মাস। অতএব সজাগ থাকতে হবে লগ্নিকারীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy