Advertisement
১১ মে ২০২৪

স্টিয়ারিং ধরেই পুড়ে মৃত্যু

ট্রেলার ও ট্যাঙ্কারের ভিতরে যে ভাবে দুই চালকের মৃতদেহ আটকে গিয়েছিল, তাতে গাড়ির বিভিন্ন অংশ কেটে তাঁদের দেহ বার করতে হয়।

মর্মান্তিক: দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গ্যাস ট্যাঙ্কার ও ট্রেলার। বৃহস্পতিবার, কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

মর্মান্তিক: দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গ্যাস ট্যাঙ্কার ও ট্রেলার। বৃহস্পতিবার, কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩১
Share: Save:

ট্রেলারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে গ্যাস ট্যাঙ্কার ফেটে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটল কোনা এক্সপ্রেসওয়ের গরফায়। বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল গোটা এলাকা। ওই ঘটনায় দু’টি গাড়িতেই আগুন ধরে যাওয়ায় ভিতরেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন দুই চালক। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন রাতের ডিউটিতে থাকা কোনা ট্র্যাফিক গার্ডের এক কর্মীও। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশে পুড়ে গিয়েছে চারটি দোকানও। প্রায় ৭০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠা আগুনের তাপে গলে যায় হাইটেনশন লাইনের সমস্ত তার। একই ভাবে আগুনের তাপে গলে গিয়েছে ঘটনাস্থল থেকে তিরিশ মিটার দূরে থাকা গরফা রেলসেতুর উপরে হাওড়া-আমতা লাইনের ওভারহেড তার। ফলে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। প্রায় দু’ঘণ্টার চেষ্টায় দমকলের পাঁচটি ইঞ্জিন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দুপুরে ঘটনাস্থলে তদন্তে আসে ফরেন্সিক দল।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ এলপিজি ভর্তি একটি ট্যাঙ্কার যখন গরফা রেলসেতু পার করে কলকাতার দিকে আসছিল, তখন হাইটবারের সামনে উল্টো দিক থেকে আসা একটি ১৪ চাকার ট্রেলারের সঙ্গে সেটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সেই ধাক্কার জেরে ভয়াবহ জোরে বিস্ফোরণ ঘটে ট্যাঙ্কারে আগুন লেগে যায়। আগুন ধরে যায় ট্রেলারেও। পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার পরে নিজেদের গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারায় দুই চালকই ভিতরে পুড়ে মারা যান। তালগোল পাকিয়ে যায় তাঁদের দেহ। মৃত ট্যাঙ্কারচালকের নাম বিন্দা চৌহান। ট্রেলারচালকের নাম দীপক শর্মা।

এই ঘটনায় আগুন লেগে যায় দুর্ঘটনাস্থলের পাশে থাকা একটি বন্ধ চায়ের দোকানেও। পুলিশ জানায়, ওই চায়ের দোকানের চালার নীচে বসেছিসেন রাতের ডিউটিতে থাকা চাঁদু সর্দার নামে এক কনস্টেবল। তিনিও মারাত্মক ভাবে পুড়ে যান। বিস্ফোরণ ও আগুন দেখে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আশপাশের বাসিন্দারা। কিন্তু ভয়াবহ আগুনের সামনে কেউ এগোতে পারেননি। ঘটনার পরেই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কোনা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যান চলাচল।

দুর্ঘটনার খবর পেয়েই তড়িঘড়ি ঘটনাস্থলে আসেন হাওড়া সিটি পুলিশের পদস্থ কর্তারা। আসেন হাওড়ার পুলিশ কমিশনার তন্ময় রায়চৌধুরী। খবর দেওয়া হয় দমকলে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই হাওড়া ও কলকাতা থেকে দমকলের পাঁচটি ইঞ্জিন আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। প্রায় দু’ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এর পরে পুলিশ ও এলাকার বাসিন্দারা অগ্নিদগ্ধ পুলিশকর্মীকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পুলিশ জানায়, ট্রেলার ও ট্যাঙ্কারের ভিতরে যে ভাবে দুই চালকের মৃতদেহ আটকে গিয়েছিল, তাতে গাড়ির বিভিন্ন অংশ কেটে তাঁদের দেহ বার করতে হয়। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের ধারণা, গরফা সেতু থেকে নামার পরে কোনা এক্সপ্রেসওয়ের দ্বিমুখী রাস্তায় ঢোকার সময়ে ওই অংশটি কিছুটা সঙ্কীর্ণ হওয়ায় গ্যাস ট্যাঙ্কারের চালক একটু বেশিই রাস্তার ডান দিকে চলে আসে। তার ফলেই উল্টো দিক থেকে তীব্র গতিতে আসা ট্রেলারের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গোটা এলাকা লোকে-লোকারণ্য। দু’টি গাড়ি থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ডান দিক ও বাঁ দিকে থাকা চারটি দোকান পুড়ে ছাই। ঘটনাস্থলের পাশেই ৭০-৮০ ফুট লম্বা একটি হাইটেনশন টাওয়ার পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। আগুনের তাপে গলে গিয়ে ছিঁড়ে পড়ে রয়েছে সমস্ত তার। তার গলে গিয়ে ঝুলছে হাওড়া-আমতা লাইনেরও।

যে জায়গায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেখান থেকে সিকি মাইল দূরেই কোনা ট্র্যাফিক গার্ডের অফিস। ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী, কোনা ট্র্যাফিক গার্ডের ওসি সুব্রত চন্দ জানান, ঘটনার সময়ে তিনি ওই ট্র্যাফিক গার্ডের অফিসেই ঘুমোচ্ছিলেন। কান ফাটানো শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তড়িঘড়ি ঘরের জানলা খুলে ওই দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান তিনি। দেখেন, দাউদাউ করে জ্বলা আগুন হাইটেনশন টাওয়ারের মাথা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।

দুর্ঘটনাস্থলের প্রায় ১০০ মিটার পিছনে একটি বাড়িতে সপরিবার থাকেন কানাইলাল সিংহ। তাঁর স্ত্রী শঙ্করী সিংহ বলেন, ‘‘প্রচণ্ড শব্দ পেয়ে জানলা খুলে দেখি, বাড়ির বাইরে গোটা জায়গাটা জ্বলছে। আর শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে। মনে হল যেন আকাশ থেকে প্লেন ভেঙে পড়েছে। দেখি, বাইরে থাকা আমার কাপড়চোপড়ও পুড়ে গিয়েছে।’’

পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘ঘটনার পরে খুব দ্রুত পুড়ে যাওয়া ট্রেলার ও ট্যাঙ্কার সরিয়ে রাস্তা চালু করা হয়েছে। আগুনে অনেকগুলি সিসি ক্যামেরা ও কেব্‌ল পুড়ে গিয়েছে। তাই ঠিক কী ভাবে ঘটনাটি ঘটল, তা জানতে আমরা বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেব। এই দুর্ঘটনার তদন্তে ফরেন্সিক পরীক্ষাও হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Road Accident Kona Expressway Tanker Blast
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE