জার্মান অধিকৃত নেদারল্যান্ডসে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচতে দু’বছর গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে ছিল ইহুদি অ্যান ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারের সদস্যেরা। সেই গোপন, নিঃসঙ্গ জীবনে অ্যানের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিল তেরো বছরের জন্মদিনে উপহার পাওয়া একটি ডায়েরি। যেখানে অ্যান লিখে রেখেছিল নিজের চিন্তা, অভিমান, যন্ত্রণা, প্রেম সব কিছু। পরে নাৎসি বাহিনীর হাতে পরিবারের সকলে ধরা পড়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ষোলো বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল অ্যানের। বেঁচে গিয়েছিলেন শুধু অ্যানের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। তিনিই ডায়েরিটি খুঁজে পেয়ে অ্যানের ইচ্ছে পূরণের জন্য বই হিসেবে তা প্রকাশ করেছিলেন। সেই ডায়েরিই, ‘অ্যান ফ্রাঙ্ক: দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’, অ্যানকে পরবর্তীকালে হলোকস্টের সময়ের অন্যতম আলোচিত মুখ করে তুলেছিল।
ঘটনাচক্রে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই যখন সেল্ফ আইসোলেশন, কোয়রান্টিনে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায় মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ কোয়রান্টিন) রয়েছেন, তখনই ইউটিউবে ‘অ্যান ফ্রাঙ্কের ভিডিয়ো ডায়েরি’-র সম্প্রচার শুরু হয়েছে। ‘দ্য অ্যান ফ্রাঙ্ক হাউস’-এর তরফে জানানো হয়েছে, প্রকল্পটির কাজ এক বছর আগে শুরু হলেও বর্তমানের ঘরবন্দি অবস্থা একদম আলাদা মাত্রা যোগ করেছে পুরো ঘটনায়। ইউটিউবে দ্বিতীয় পর্বেই দেখানো হয়েছে, গোপন জীবন নিয়ে অ্যানের অনুভূতি, ‘খুব একা লাগছে’ (‘ফিলিং সো লোনলি’)।
যে প্রসঙ্গ টেনে মনোরোগ চিকিৎসকদের একটি অংশ জানাচ্ছেন, অ্যানের ডায়েরির মতো এই মুহূর্তে ঘরবন্দি ছোটদের হাতে যদি লেখার বা আঁকার খাতা তুলে দেওয়া যায়, তা হলে তাদের মনের অবস্থা জানা যাবে। ভবিষ্যৎ গবেষণায় যা গুরুত্বপূর্ণ নথি হতে পারে। কারণ, সংক্রমণের ফলে ‘অদৃষ্টপূর্ব’ পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষা পিছিয়েছে, স্কুল-কোচিং বন্ধ, বাইরের যে জীবন তা থেকে হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে ছোটদের। কিশোর-কিশোরীরা বা প্রাপ্তবয়স্কেরা লকডাউনের অর্থটা জানেন। কিন্তু ছোটদের কাছে কারণটা স্পষ্ট নয়। ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র অধিকর্তা প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘অভিভাবকেরা বাড়ির ছোটদের খাতা-পেন দিন। তারা এই লকডাউনের সময়ে নিজের মতো লিখুক, আঁকুক। কোথায় তাদের খারাপ লাগছে, কী সে আনন্দ, তা নথিবদ্ধ করে রাখলে ভবিষ্যতের গবেষণায় কাজে লাগবে।’’
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর প্রশান্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সাহিত্যে পড়া জীবনের অনিশ্চয়তার সঙ্গে এখনকার জীবন মিলে যাচ্ছে। আমরা অনেক কিছু পড়ছি, শুনছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনওটির নির্দিষ্ট বা সঠিক উত্তর পাচ্ছি না।’’ আর অনিশ্চয়তার মাত্রা বৃদ্ধি হওয়ার কারণে তা ক্রমশ অবসাদে পরিণত হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরা।
ঘটনাচক্রে গত ৩০ জানুয়ারি, কোভিড-১৯ নিয়ে দশম ‘সিচুয়েশনাল রিপোর্ট’ প্রকাশের দিন আরও একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল হু। মানসিক অবসাদ সংক্রান্ত ওই রিপোর্টে হু বলেছিল, বিশ্বে ২৬ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ মানসিক অবসাদের শিকার। প্রতি বছর প্রায় আট লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করেন। ১৫-২৯ বছর বয়সিদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে আত্মহত্যা। এক গবেষকের কথায়, ‘‘দুর্ভাগ্যের বিষয়, সমস্যা গুরুতর হলেও মধ্য ও নিম্ন আয়ের প্রায় ৭৬-৮৫ শতাংশ মানুষের মানসিক অবসাদের কোনও চিকিৎসা হয় না। আবার আর্থিক ক্ষমতা থাকলেও অনেকে অবসাদের চিকিৎসা করাতে চান না।’’
ডায়েরির একটি জায়গায় অ্যান লিখেছিল— ‘যা হয়ে গিয়েছে, তা আর পাল্টানো যাবে না। কিন্তু আবারও এটা হওয়া থেকে আটকানো যেতে পারে।’সাম্প্রতিক পরিস্থিতি জটিল, তবু মনোরোগ চিকিৎসকেরাও বলছেন, এই দুঃসময়ে যা-যা অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সংক্রমণ রুখতে যা-যা সতর্কতামূলক অভ্যাস তৈরি হচ্ছে, তা যদি ভবিষ্যতেও ধরে রাখা যায়, তা হলে আগামী বিপর্যয় আটকানো যাবে।
প্রেক্ষিত আলাদা ঠিকই। কিন্তু এই ভরসা, এই বিশ্বাসেই মিলে যাচ্ছে দুই সময়ের জীবন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy