শিশু কোলে রেলপথই আশ্রয়।
রাত আড়াইটে হবে। শীতের রাতে বালাপোশ গায়ে দিয়ে আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আচমকাই মনে হল কেউ যেন গলা টিপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। প্রথমে ভাবলাম, স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু চটকা ভাঙতেই তীব্র ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে গেল। ঘরের বাইরে লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনছি। সবাই বলছে আগুন লেগেছে।
আমার বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুভাষগ্রামে। পরিবারের লোকজন সেখানেই থাকেন। আমি সুভাষ কলোনিতে থাকি তিরিশ বছর। এ দিন অন্ধকার ঘরে একাই ছিলাম। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সারাটা ঘর ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছে। এক চিলতে জানলার পর্দাটা সরিয়েই দেখি, বাইরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, খুব তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোতে না পারলে আগুনের মধ্যে পড়ে যাব। আমার ঘরের তিন দিকে তখন আগুন।
তার মধ্যেও এক বার জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি, প্রতিবেশীদের কেউ কাঁদছেন, কেউ বা প্রাণপণে নিজের জিনিসপত্র বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কেউ আবার বালতি করে জল নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। বেশ কয়েক বার চিৎকার করে তাঁদের ডাকালাম। আমার চিৎকার কেউ অবশ্য শুনতে পেলেন না। তাঁরা নিজেরা বাঁচবেন, না আমাকে বাঁচাবেন!
ইটের গাঁথনির ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে কয়েকটি লোহার শিক বসানো ছোট্ট জানলা। তার পাশে চৌকিতে ঘুমোই আমি। লেপ, কম্বল, কাঁথা রাখা ছিল বিছানার উপরেই। বালাপোশটা শরীরে জড়িয়ে কোনও ভাবে ঘর থেকে বেরোব ভাবছি, ইতিমধ্যেই হঠাৎ আগুনের শিখা জানলার উপরে এসে পড়ল। তাকিয়ে দেখি, লেপ-কম্বলেও ততক্ষণে আগুন লেগে গিয়েছে।
রিকশা চালিয়ে আর জোগাড়ের কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। ভোটার কার্ড আর সেই টাকা রাখা ছিল বিছানার তলায়। সংক্রান্তির স্নানের জন্য ক’দিন পরেই বাড়ি যাওয়ার কথা। কিন্তু লেপ-কম্বলের সঙ্গে বিছানাতেও তখন আগুন ধরে গেছে। টাকাগুলি আর বাঁচাতে পারলাম না। ফ্রেমটুকু কাঠের হলেও আমার ঘরের দরজাটি বাঁশের। মনে সাহস সঞ্চয় করে বালাপোশটা গায়ে জড়িয়ে বাঁশের দরজাটাকে কয়েক বার সারা শরীরের শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারতেই সেটি ভেঙে গেল। কোনও মতে ছিটকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে রেললাইনের উপরে উঠে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম, দাউদাউ করে জ্বলছে আমার ছোট্ট ঘরটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy