বর্ণাঢ্য: শোভাযাত্রায় প্রতিমার সারি। মঙ্গলবার, রেড রোডে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সন্ধ্যা ঘন হতেও ব্যারিকেডের ধার ঘেঁষে উপচে পড়ছে অক্লান্ত জনতা। আর ভিতরে মূল মণ্ডপে টানা চারটি ঘণ্টা কার্যত ঠায় দাঁড়িয়ে তিনি। মঙ্গলবার, বিসর্জনের শেষ দিন বিকেল থেকে এ ভাবেই কার্যত পুরোভাগে থেকে দুর্গার কৈলাসযাত্রার তত্ত্বাবধান করে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
গত তিন বছর ধরেই বাঙালির পুজো নির্ঘণ্টয় ঢুকে পড়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘বিসর্জন কার্নিভাল’! নেট দুনিয়ায় তা নিয়েও রসিক বাঙালির হাসি-ঠাট্টার কমতি নেই। কেউ বলছেন, ‘দিদির রাজ্যে’ ঠাকুর থাকবে কত ক্ষণ, তা-ও তিনিই ঠিক করে দেবেন। কারও টিপ্পনী, বাঙালি কি সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে বিসর্জনকে সংস্কৃতি করে তুলল! রেড রোডে শোভাযাত্রার মূল অঙ্গনে ঢুকতে না পারা পুজোপাগলদের ভিড় কিন্তু বলে গেল, এক সঙ্গে কলকাতার সেরা প্রতিমা দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি অনেকেই। শোভাযাত্রার বাংলা ও ইংরেজি ধারাবিবরণীও বারবার কলকাতার এই কার্নিভালের সঙ্গে ব্রাজ়িলের রিয়োর সামার কার্নিভালের তুলনা টানতে কসুর করেনি। কলকাতার এই আনন্দযজ্ঞ ধারে-ভারে দুনিয়ার যে কোনও বড় উৎসবের সমান, তা প্রতিপন্ন করতেও যেন তৎপর থাকল প্রশাসন।
শোভাযাত্রা স্থলে সাবেক অভিজাত দালানকোঠার আদলে মূল মণ্ডপ। সেখানে দাঁড়িয়ে কখনও জোড় হাতে, কখনও হাসিমুখে মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন পুজোর থিম উপস্থাপনার প্রয়াসটুকুও যেন মুখ্যমন্ত্রীকেই উৎসর্গীকৃত। এ বছরই বিতর্কের আবহে রাজ্যে পুজোর জন্য ২৮ কোটি টাকার অনুদান ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দেখা গেল, তাঁর ভাবনাপ্রসূত ‘বিসর্জনের কার্নিভাল’ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন পুজো কমিটির বিজয়া সম্মেলনের চেহারা নিয়েছে। মঞ্চে শাসক দলের তাবড় নেতা-মন্ত্রী, আমলা-পুলিশ থেকে চিত্রতারকা বা সংস্কৃতিজগতের বিশিষ্টজনেরা একাকার। আর মঞ্চের সামনে মুখ্যমন্ত্রীকে সম্ভাষণে ব্যস্ত বিভিন্ন পুজোর শোভাযাত্রায় হাজির ছোট-বড় শিল্পীরা। পদ্মাবত সিনেমার বহুল আলোচিত রাজস্থানি ঘুমর লোকনৃত্যের তালে ঢাক বাজাচ্ছেন মুম্বইয়ের সঙ্গীতশিল্পী অভিজিৎ। কিংবা একটি পুজোর থিম-উপস্থাপনায় দুর্গার ভূমিকায় নৃত্যরত ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। প্রসেনজিৎ থেকে নুসরতের মাঝে বসে এই দৃশ্য চাক্ষুষ করছেন মুখ্যসচিব মলয় দে কিংবা পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র! গোটা দৃশ্যপট অতএব রাজ্য প্রশাসন তথা বিনোদন জগতের বিজয়ার জলসাই হয়ে উঠেছে।
শোভাযাত্রায় বারোয়ারি পুজো ছিল এ বার ৭২টি। কয়েকটি পুজোর থিমের উপস্থাপনাতেই রাজ্য সরকারের বন্দনা। কেউ ট্যাবলোয় বাংলার উন্নয়ন-গাথা তুলে ধরছে। কোনও পুজোর ঘোষণা, ‘বঙ্গজননী লহ প্রণাম’ কিংবা ‘বঙ্গজননী তোমার ছোঁয়ায় বাংলা আজ বিশ্ববাংলা’! সব কিছু ভাল ভাবে মেটার জন্য বিসর্জনের কার্নিভাল যেন মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকারের উদ্দেশে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের আসর হয়ে উঠেছে। তবে পুজোর রং-গন্ধ-আমেজে অবশ্য কম পড়েনি। তাই থিমের উপস্থাপনার জুরাসিক পার্ক থেকে নারীশক্তির উত্থানের মডেল দেখে বিভোর হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মান্যগণ্যেরাও। তুবড়ির রোশনাইয়ে বর্ণময় কয়েকটি পুজোর উপস্থাপনা। প্রতিমারও বিচিত্র রকমফের। একডালিয়া বা বালিগঞ্জের সাবেক কুমোরটুলি ঘরানার ঠাকুর, যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লির অবিশ্বাস্য খড়-কাগজের মণ্ডের ঠাকুর কিংবা বেহালার ধাতব ঠাকুর— দেখে মোবাইলে ছবি তুলতে উঠে দাঁড়িয়েছেন কলকাতায় বিভিন্ন দেশের কনস্যুলেটের কূটনীতিকেরাও। ফরাসি সংস্কৃতি কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের এক কর্তা আপন মনেই ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’র তালে চোখ বুজে দুলতে শুরু করলেন। টলিউডি তারকারা তখন শোভাযাত্রার মাঝে নেমে নাচছেন।
কিছু ক্ষেত্রে শোভাযাত্রার ট্যাবলোর মুখ পুরোই মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চের দিকে ফেরানো। ফলে বাকিরা কিছুই দেখতে পাননি। নাচগানের উপস্থাপনাও শুধু মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চের সামনে। এক বিদেশি দূতাবাসের আধিকারিক এই নিয়ে মৃদু অনুযোগও করলেন। ব্রিটেন থেকে আসা এক ঝাঁক পর্যটককে কার্নিভাল দেখতে ডেকেছিল রাজ্য পর্যটন দফতর। তাঁরা অনেকেই খানিক ক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেলেন। মূল মঞ্চের কছে বসলে টিভি-র ‘জায়ান্ট স্ক্রিনে’ অনুষ্ঠান দেখার সুবিধা, কিন্তু দূরে বসা দর্শকেরা ব্রাত্য হয়েই থাকলেন। শোভাযাত্রা শেষে ভাসানের আগে ম্যাটাডরে রাখা প্রতিমাকেও পুজোপাগলদের ভিড়ই অনেক ক্ষণ আগলে থাকল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy