হেলমেট ছাড়াই শহরের পথে বাইক-আরোহী। মঙ্গলবার, কলেজ স্ট্রিটে দেশকল্যাণ চৌধুরীর তোলা ছবি।
দুর্ঘটনার অভাব নেই। মৃত্যুও ঘটছে আকছার। শাস্তির ভয়, জরিমানা এবং পুলিশি ধরপাকড়েও কাজ হচ্ছে না। হেলমেট না পরে মোটরবাইক চালানোর বেপরোয়া প্রবণতায় দাঁড়ি টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। অথচ, হেলমেটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার বিকল্প প্রস্তাব পড়েই রয়েছে ঠান্ডা ঘরে।
বিভিন্ন বাইকার্স র্যালি গ্রুপ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ারা জানাচ্ছেন, অটোমোবাইল সংস্থাগুলিকে দীর্ঘদিন ধরেই তাঁরা প্রস্তাব দিয়ে আসছেন যে, এ দেশে হেলমেট মাথায় না থাকলে বাইকের ইঞ্জিন চালু না হওয়ার প্রযুক্তি আনতে। এ জন্য মোবাইলের ‘ফেস রেকগনিশন’-এর মতো ‘হেলমেট রেকগনিশন’ প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা বলছেন তাঁরা। সম্প্রতি একটি মোটরবাইক প্রস্তুতকারক সংস্থা যে প্রযুক্তি এনেছে, তাতে সাইড স্ট্যান্ড নামানো থাকলে মোটরবাইক চালু করতে পারবেন না চালক। সেই খবর ছড়াতেই হেলমেট-প্রযুক্তি ব্যবহারের দাবি নতুন করে গতি পেয়েছে। ‘কলকাতা বাইকার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য তৃষা সরকার বলেন, ‘‘বহু দুর্ঘটনার পরে দেখা গিয়েছে, মোটরবাইকের সাইড স্ট্যান্ড নামানো ছিল। নিরাপত্তার কথা ভেবে সাইড স্ট্যান্ডের ক্ষেত্রে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার করা যায়, তা হলে হেলমেটের ক্ষেত্রে নয় কেন?’’
কী ভাবে কাজ করবে ব্যবস্থা
• হেলমেট মাথায় বাইকে বসলে হেলমেট সার্কিটের ট্রান্সমিটার চালু হয়ে যাবে
• হেলমেট থেকে সিগন্যাল যাবে বাইকে লাগানো রিসিভারে
• রিসিভারের গায়ের সবুজ আলো জ্বলে উঠবে
• বাইকের ইগনিশন সুইচ চালু হবে
• এর পরেই বাইক চালু করা যাবে
২০১৩ সালে এই ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিলেন সুরাতের চার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া। তাঁদের প্রকল্পে হেলমেট না পরলে মোটরবাইক তো স্টার্ট হবেই না, সেই সঙ্গে মত্ত অবস্থায় বাইক স্টার্ট করার চেষ্টাও বিফল হবে। ওই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ারা হেলমেটে একটি সেন্সর লাগানো ট্রান্সমিটার বসান। আর একটি রিসিভার বসানো হয় মোটরবাইকের ইঞ্জিনের গায়ে। এই ব্যবস্থায় চালক হেলমেট পরে মোটরবাইকের সিটে বসলেই ট্রান্সমিটার সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করবে। রিসিভার হেলমেট পরে থাকার ছাড়পত্র পেয়ে ইঞ্জিনকে স্টার্ট দেওয়ার ছাড়পত্র দেবে। সেই সঙ্গে সেন্সর জানান দেবে, চালক মত্ত অবস্থায় রয়েছেন কি না। এ ক্ষেত্রে সেন্সর লাগানো ট্রান্সমিটার পুলিশের ব্রেথ অ্যানালাইজারের মতো কাজ করবে বলে দাবি ওই পড়ুয়াদের। তাঁদের যুক্তি, এই পদ্ধতিতেই এখন হৃৎকম্পন থেকে ইসিজি মাপা যায় স্মার্ট ওয়াচে।
সুরাতের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের কাজ সে ভাবে প্রশাসনের গ্রহণযোগ্যতাও পায়নি। শুধু মোটরবাইক যন্ত্রাংশের বাজারে এই ধরনের কিছু হেলমেট বিক্রি হয় ‘স্মার্ট হেলমেট’ নামে। দাম পড়ে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা।
বে-হুঁশ: হেলমেট ছাড়াই শহরের পথে বাইক-আরোহী। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
এ রাজ্যের একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান সুদীপ্ত চাকী অবশ্য জানাচ্ছেন, তাঁর ছাত্র সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় একই রকম ‘ইন্টেলিজেন্ট হেলমেট’ বানিয়েছিলেন ছ’বছর আগে। প্রকল্পটি নানা মহলে স্বীকৃতিও পায়। সুদীপ্ত বলেন, ‘‘আমাদের ছাত্র দেখিয়েছে, কত সহজে হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালানো আটকানো যায়।’’ যদিও বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই ধরনের প্রকল্প ব্যবসায়িক ভাবে
বাস্তবায়িত করা সমস্যার। এ হেন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাইকের দাম বাড়লে ক্রেতারা তাতে আকৃষ্ট হবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন, হেলমেট যে হেতু মোটরবাইকের নিজস্ব অংশ নয়, ফলে এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার কতটা কার্যকরী হবে, তা নিয়েও সংশয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি মোটরবাইক প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি।
সাইড স্ট্যান্ড প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চললেও ‘রয়্যাল এনফিল্ড’ সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, এ ব্যাপারে এখনও তারা সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে আন্তর্জাতিক মোটরবাইক সংস্থাগুলি জানাচ্ছে, হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালু না হওয়ার প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা এক কথায় দারুণ। সওয়ারিদের নিরাপত্তা যে হেতু তাদের সব চেয়ে বেশি চিন্তার বিষয়, তাই এই প্রকল্প তাঁদের ভাবনাচিন্তায় রয়েছে।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্র্যাফিক) মিতেশ জৈন বলেন, ‘‘দেখতে হবে বিষয়টি। তার পরেই কিছু বলা সম্ভব।’’ লালবাজারের আর এক কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘পথ দুর্ঘটনা নিয়ে সারা বছর আমাদের প্রচার অভিযান চলে। প্রস্তাবটি ভাল।’’
তা-ও এই প্রস্তাব হালে পানি পায় না কেন?
পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, ‘‘আমাদের কাছে প্রস্তাব এলে আমরা অবশ্যই দেখব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy