Advertisement
২৭ জুলাই ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

পরিবেশ গবেষণার এটাই উপযুক্ত পথ

পরিবেশ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বহু আলোচনা এবং গবেষণা চালু হয়েছে। পরিবেশ, জীবনধারণ, উন্নয়ন ইত্যাদি আজ অর্থনীতির মূলধারার উপাদান। কিন্তু এই ধরনের সমস্যার তাত্ত্বিক এবং তথ্যগত বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে সামগ্রিক ভাবে প্রামাণ্য পুস্তক পাওয়া দুষ্কর।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

পরিবেশ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বহু আলোচনা এবং গবেষণা চালু হয়েছে। পরিবেশ, জীবনধারণ, উন্নয়ন ইত্যাদি আজ অর্থনীতির মূলধারার উপাদান। কিন্তু এই ধরনের সমস্যার তাত্ত্বিক এবং তথ্যগত বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে সামগ্রিক ভাবে প্রামাণ্য পুস্তক পাওয়া দুষ্কর। পৃথিবীর পরিবেশজনিত সমস্যার সঙ্গে ভারতবর্ষের কী সম্পর্ক, আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, কী কী আমাদের জানা উচিত, নীতিকারদের কোন কোন ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে, সেই সব নিয়ে উচ্চ মানের গবেষণাপ্রসূত কাজ দুর্লভ। অর্থনীতিবিদ রামপ্রসাদ সেনগুপ্তের বইটি এ বিষয়ে অপরিহার্য সংযোজন। অধ্যাপক সেনগুপ্তের যে-কোনও গবেষণাপত্রে তথ্য, তত্ত্ব এবং যাবতীয় উপাদানের ব্যাপ্তি ও প্রসারের কথা সুবিদিত। আমি কতকগুলো বিশেষ দিক নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

বইটিতে পরিবেশ, জাতীয় আয় ও আয়বৃদ্ধির পরিমাপ নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। ‘গ্রিন অ্যাকাউন্টিং’ বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি বা আমাদের কী ভাবে ব্যাপারটি বোঝা উচিত, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা প্রাকৃতিক মূলধনের অপচয় করি, কারণ কোনও ধরনের অর্থনৈতিক আলোচনায় উপাদান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক মূলধন, যেমন জল, হাওয়া, শুদ্ধ বাতাস এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, ফলে আমরা লাগামছাড়া আয়বৃদ্ধি, বিনিয়োগের হারে বৃদ্ধি এ সব নিয়ে খুব উত্তেজিত হই। অধ্যাপক সেনগুপ্ত বলছেন, মূলধারার ধনতান্ত্রিক কিংবা মার্কসীয় অর্থনীতি কোথাও এই গ্রহের প্রাকৃতিক মূলধনের ক্ষয় বা বৃদ্ধি নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা দেখা যায়নি। আমরা গাণিতিক ভাবে সীমিত রসদের ব্যবহারে যে কাম্যস্তর বা অনুপাত নির্ধারণ করি, সেই সব পরিমাপ আসলে ঠিক নয়। কারণ, যেহেতু প্রাকৃতিক মূলধনের বা উপাদানের কোনও দাম কেউ ধার্য করে না, সেগুলো আমরা অত্যধিক ব্যবহার করি।
অধ্যাপক সেনগুপ্ত বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন পৃথিবীর ‘বায়ো-ক্যাপাসিটি’র ঠিক পরিমাপ এবং এর কতটা আমরা ব্যবহার করে ফেলছি। পৃথিবীর বা যে-কোনও জায়গার পরিবেশকে কতটা ব্যবহার করা যায়, তার একটা সূচক হিসেবে আমরা ‘বায়ো-ক্যাপাসিটি’কে দেখতে পারি, যেমন আসলে পরিবেশকে কতটা ব্যবহার করছি, তার একটা পরিমাপ হল ‘ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট’। পৃথিবীর মাথাপিছু বায়ো-ক্যাপাসিটির তুলনায় ভারতে মাথাপিছু ব্যবহার-এর পরিমাণ অর্ধেকের কম। কিন্তু চিনে প্রায় সমান-সমান।
বইটির একটি বিশেষ সম্পদ তথ্যসম্ভারকে একত্র করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। অর্থাৎ, বিভিন্ন সূত্র থেকে জোগাড় করা তথ্য, সূচক নির্মাণের আখ্যান ও সর্বোপরি আমাদের দেশের প্রতিটি রাজ্যের পরিবেশ, উন্নয়ন এবং দারিদ্র নিয়ে বিশদ আলোচনা। বইটি মনে করিয়ে দেয়, সামগ্রিক ভাবে বিশ্বে পরিবেশ শোষণ অব্যাহত ও ঊর্ধ্বমুখী। অর্থাৎ, বায়ো-ক্যাপাসিটির তুলনায় ইকোলজিকাল ফুটপ্রিন্ট অনেকটাই বেশি। অবশ্যই পৃথিবী জুড়ে তার বণ্টন সুষম নয়।
জনসংখ্যার চাপ পরিবেশের ক্ষতির অন্যতম কারণ, একমাত্র কারণ নয়। দারিদ্র ও অশিক্ষা অনেক সময়ই হাতে হাত ধরে এগোয়। সীমিত প্রাকৃতিক রসদ শোষণ না করার শিক্ষা অনেক সময়ই সরকারি গাফিলতিতে উপেক্ষিত হয়। দারিদ্রমোচনের উপায় হিসেবে বিভিন্ন নীতি ও পন্থা ঠিক মতো কাজ না করলেও পরিবেশজনিত সমস্যা বাড়তে পারে।
বইটির প্রায় প্রতি অধ্যায় আলাদা আলাদা করে এক একটি বইয়ের উপাদানে ঠাসা। যেমন জমি ও অরণ্য নিয়ে কাজ করতে যাঁরা উৎসাহী, তাঁরা ভারতে এবং বিশ্বে কী হারে জমি ও অরণ্য সংরক্ষণে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, তা নিয়ে তথ্যবহুল বিশ্লেষণ পাবেন। একটা ব্যাপারে ভারতে কিছু কাজ হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০০০-এর মধ্যে যে হারে অরণ্যের ব্যাপ্তি কমেছে, তার চেয়ে বেশি হারে কাঠের বাণিজ্যিক ব্যবহার কমেছে। ব্যবসায়িক কারণে ব্যবহৃত অরণ্যের পরিমাণ তুলনায় কম হওয়ায় অরণ্য সংরক্ষণে খানিকটা উন্নতি হয়েছে। ২০০০ থেকে ২০০৫-এর মধ্যে উৎপাদনশীল অরণ্যাংশের আয়তন ২৫ লক্ষ হেক্টর বৃদ্ধি হয়েছে।

লেখক জনপ্রিয় স্তরে সর্বাধিক আলোচিত জ্বালানির উৎস, উষ্ণতা ও আবহাওয়া পরিবর্তনের ওপর আলোকপাত করেছেন। পরমাণু শক্তি চালিত জ্বালানির প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই জ্বালানি এমনিতে পরিবেশ দূষণ করে কম, কিন্তু এই জ্বালানির সংরক্ষণ এবং এর দুর্ঘটনাজনিত ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়েও চিন্তার অবকাশ অনস্বীকার্য। কোন ধরনের জ্বালানির কী সমস্যা, সে সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়টির আলোচনা এই বইটিতে বিশেষ ভাবে স্থান পেয়েছে।

অধ্যাপক সেনগুপ্তের যে কোনও বিষয়ের গভীর প্রবেশ করার প্রবণতা এবং সে জন্য কঠোর পরিশ্রমের কথা সুপরিচিত। যখন তিনি ইস্পাত নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তখন শোনা যায়, ইস্পাত-ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে ইস্পাত শিল্প সম্পর্কিত কারিগরি জ্ঞান তাঁর কম আয়ত্ত ছিল না। আবার, এই কারণেই হয়তো কিছু কিছু জায়গায় পরিবেশ সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে আসার আগে গৌরচন্দ্রিকা একটু বেশি বিস্তৃত হয়েছে। দারিদ্র, জনসংখ্যা এবং জমি সংক্রান্ত ভূমিকাসূচক আলোচনায় অতিবিস্তৃতি হয়তো নতুন পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। তবে, বিশদ এবং গভীর আলোচনার মধ্যে সূক্ষ্ম বক্তব্য হারিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE