Advertisement
১৭ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

বাংলা সাহিত্যে হাকলবেরি ফিন হয় না

নিবেদিতা সেন-এর বিশ শতকের বাংলা শিশুসাহিত্যে ছোটদের অবস্থান ও চিত্রায়ণ নিয়ে গবেষণাগ্রন্থে উনিশ শতকীয় এই নীতিশিক্ষার প্রবণতা এসেছে শুরুর কথা হিসেবে।

ফ্যামিলি, স্কুল অ্যান্ড নেশন/ দ্য চাইল্ড অ্যান্ড লিটারারি কনস্ট্রাকশনস ইন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল। নিবেদিতা সেন। রাটলেজ ইন্ডিয়া, ৮৯৫.০০

ফ্যামিলি, স্কুল অ্যান্ড নেশন/ দ্য চাইল্ড অ্যান্ড লিটারারি কনস্ট্রাকশনস ইন টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল। নিবেদিতা সেন। রাটলেজ ইন্ডিয়া, ৮৯৫.০০

সীমন্তী সেন
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে
আমি যদি পারি বাসা নিতে
তবে আমি একবার
জগতের পানে তার
চেয়ে দেখি বসি সে নিভৃতে।

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘খোকার রাজ্য’, শিশু)

কবির মনে যাই থাক না কেন, উনিশ শতকের বাংলায় ছোটদের জন্য লেখালেখি এমন তাগিদ থেকেই শুরু হয়েছিল তা বলা যায় না। খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে বাংলায় শিশুদের জন্য প্রাইমার এবং পরবর্তী কালে এদেশীয়দের তৎপরতায় যে সব পাঠ্যপুস্তক লেখা হয়েছিল তার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক জ্ঞান, বিজ্ঞানের কিছু বিষয় জানানোর সঙ্গে ছোটদের নীতিশিক্ষা দেওয়া। অর্থাৎ, ইংরেজিশিক্ষিত ভদ্রলোকশ্রেিণর নবলব্ধ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-ভুল ইত্যাদির ধারণায় জারিত ‘আধুনিক’-মনস্ক ‘আদর্শ’ ‘ছেলে’ গড়া। এ ‘আদর্শ’ গ্রহণ-বর্জনের মাপকাঠির সবথেকে প্রভাবশালী আর্কিটাইপ তৈরি করে দেন বিদ্যাসাগর, ‘গোপাল-রাখাল’-এর দ্বিত্বে।

নিবেদিতা সেন-এর বিশ শতকের বাংলা শিশুসাহিত্যে ছোটদের অবস্থান ও চিত্রায়ণ নিয়ে গবেষণাগ্রন্থে উনিশ শতকীয় এই নীতিশিক্ষার প্রবণতা এসেছে শুরুর কথা হিসেবে। সঙ্গে বিশদে আলোচিত পশ্চিমি দুনিয়ায় গ্রিক শিক্ষাভাবনা থেকে ক্যালভিন হয়ে রুশো এবং তৎপ্রভাবিত রোম্যান্টিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মার্ক টোয়েন-এ পৌঁছনর পথে কৈশোর, শৈশবের ধারণার বিবর্তন ও বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব।

মূল আলোচনা সাজানো হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক পরিচ্ছেদে— যেমন, ‘বিশ শতকে গৃহ, পরিবার ও ছোটরা’, ‘স্কুল এবং শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অসন্তোষ বৃদ্ধি’, ‘পালিয়ে যাওয়া— বাস্তবিক এবং কাল্পনিক’, ‘জাতির সমস্যা ও ছোটদের প্রতিক্রিয়া’, ‘বিদ্রোহী বালক ও সামাজিক সমঝোতা’ ইত্যাদি।

প্রতিটি বিষয়ের সাহিত্যিক চিত্রায়ণের যথার্থতা বোঝার জন্য আলোচিত হয়েছে পশ্চিমী এবং দেশজ মনস্তাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের মতামত। যেমন, শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ‘গিন্নি’, ‘তোতাকাহিনী’, অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’, শরৎচন্দ্রের ‘পণ্ডিতমশায়’ বা সুকুমার রায়ের ‘ঝালাপালা’-র মতো গল্পের অথবা কার্তিকেয়চন্দ্র বা রাজনারায়ণ বসুর আত্মজীবনী জাতীয় রচনার বিশ্লেষণের জন্য ডিকেন্স কিংবা হার্ডির রচনার প্রভাব ছাড়াও এসেছে অপর্ণা বসু, হিতেশ সান্যাল, সুমিত এবং তনিকা সরকার প্রমুখের গবেষণার প্রসঙ্গ। এঁদের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের সূত্রে ব্যাখ্যাত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রতিস্থাপনার অন্তর্গত দোলাচল— কখনও পাঠশালার অনুন্নত শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে অসন্তোষ এবং অপূর্ণতাবোধ, কখনও আবার জাতীয়তাবাদী স্বপ্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে ইংরেজ প্রবর্তিত কারখানা-সদৃশ স্কুলব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশজ পাঠশালাকেই আদর্শ হিসেবে দেখার প্রবণতা। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে নানা দোলাচল সত্ত্বেও, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নিয়ে লেখকদের মনে কোনও সংশয় ছিল না।

ঠিক এ ভাবেই গল্প উপন্যাসে পরিবারের সঙ্গে ছোটদের টানাপড়েনের বিষয়টির সূত্রে কখনও উঠে আসে ট্যালকট পার্সনস বা গোল্ডথ্রপের, কখনও বা সুধীর কক্কর কিংবা আঁদ্রে বেতেই-এর তত্ত্বায়ন। লেখক জানান যে উনিশ শতকের তুলনায় বিশ শতকের সাহিত্যে কিশোরদের অনেক বেশি প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখা যায়। এ সময় থেকেই যেন খোকার মনের ঠিক মাঝখানটিতে বাসা নেওয়ার প্রকৃত চেষ্টা শুরু হয়। এ পর্যায়ে ছোটরা অনেকেই ঘর ছেড়ে বেরোতে চায়, অচেনা হাতছানি দেয়, গুরুজনদের কর্তৃত্ব অমান্য করার ইচ্ছেও জাগে। স্পষ্টই, গোপাল-রাখালের দ্বন্দ্বের ছকে ছোটদের দেখার প্রবণতা অনেকটাই প্রশমিত হয়; কিন্তু অন্তর্হিত হয় না। যেমন, প্রায় সব প্রতিবাদই শেষ হয় ‘ঘরে ফেরায়’ বা সমঝোতায়। কামিনীসুন্দরীর ‘বরদা-সারদা’ থেকে বীরু চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুষ্টু ছেলের সংঘ’ একই নকশা। কিশোরীদের চিত্রায়ণের ক্ষেত্রেও বিশ শতকের শুরু থেকে মধ্যভাগে গিয়ে আমরা তথাকথিত ‘ভাল মেয়ের’ মডেলে চিড় ধরতে দেখি। উদাহরণ পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘শান্তশীলা’ থেকে রেবা সিংহের ‘দুষ্টু মেয়ে চাই’। তবে দু’ক্ষেত্রেই ‘দুষ্টু’ হওয়ার নির্ধারিত সীমা খুব প্রশস্ত নয়।

ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে পরিচ্ছেদটি মনোগ্রাহী। এ পালিয়ে যাওয়া কখনও বাস্তবিক পালানো, কখনও বা নিছক কল্পনা— অন্য কোনও ভূমিকায় নিজেকে দেখতে চাওয়া। এখানে ফিরে ফিরে আসে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’, শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, লীলা মজুমদারের ‘ঘোতন কোথায়’, ‘হলদে পাখির পালক’, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘ভোম্বল সর্দার’, আশাপূর্ণা দেবীর ‘এক সমুদ্দুর অনেক ঢেউ’, সত্যজিৎ রায়ের ‘ফটিক চাঁদ’-এর প্রসঙ্গ। লেখকের বক্তব্য যে বেশিরভাগ গল্পেই ছোটরা শুধুমাত্র অ্যাডভেঞ্চারের তাগিদে ঘরের চৌহদ্দি পার করে না, কোথাও সে স্কুল পালাতে চায়, কোথাও পারিবারিক অনুশাসন বা শৃঙ্খলা থেকে মুক্তি খোঁজে, আবার কখনও ব্যাপারটা ঘটে যায় তার ইচ্ছানিরপেক্ষ ভাবে। ‘চাঁদের পাহাড়’ এ সবের নিরিখে হয়ত কিছুটা ব্যতিক্রমী, কারণ এখানে অ্যাডভেঞ্চার হয় অ্যাডভেঞ্চারের জন্যই। অনেকটা পরিসর পেয়েছে ডিটেকটিভ হওয়া বা ডিটেকটিভের সঙ্গী হওয়ার কাহিনি। এই জাতীয় গল্পে ছোটরা তাদের পরিচিত চৌহদ্দির অনেকটা বাইরে চলে যায়। তা কেবলমাত্র কাকাবাবু-সন্তু বা ফেলুদার গল্পের মতো নিছক নানা জায়গায় যাওয়াই নয়, এখানে তারা চেনা চৌহদ্দির মধ্যে মানুষের অচেনা দিক চিনতে শেখে। এ ধারার রচনায় পশ্চিমি প্রভাব যে স্পষ্ট লেখক তা পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে ভোলেন না।

সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় যা সরাসরি ছোটদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত নয় লেখকের মতে এ জাতীয় সাহিত্যে তার উল্লেখ তুলনায় কম। কিন্তু যতটুকু পাওয়া যায়, যেমন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিলালিপি’ বা নীহাররঞ্জন গুপ্তর ‘শঙ্কর’ ইত্যাদি— তাতে লেখক মনে করছেন যে এখানে গোপাল-রাখালের ছকটা অনেকটা বদলে যায়। এরকম দু একটি উদাহরণ ব্যতিরেকে এই পরিচ্ছেদের মূল আলোচনার বিষয় গেলনার থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত ‘জাতীয়তাবাদ’সংক্রান্ত তত্ত্বায়ন এবং সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’। শিলালিপি বা ঘরে বাইরে-কে ঠিক এই ভাবে ছোটদের সাহিত্য আলোচনায় নিয়ে আসা যায় কি না তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে।

শেষ অধ্যায় হল মূল বক্তব্যের সারসংক্ষেপ। অ্যাডভেঞ্চার বা প্রতিবাদ যাই হোক না কেন, সন্তোষজনক পরিসমাপ্তি, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত বোধ-বিশ্বাসের সঙ্গে সমঝোতাই দস্তুর। ‘পাগলা দাশু’ বা ‘ভীমের কপাল’ জাতীয় ধারাবাহিকগুলিতে, ধারাবাহিকতার তাগিদেই সমাধানটা এত স্পষ্ট হয়ে উঠতে না পারলেও পূর্ণাঙ্গ কাহিনিগুলোতে এই ছক স্পষ্ট। মধ্যবিত্ত মানসিকতার এই লেখকরা সামাজিক সমস্যার ততটুকু আভাসই ছোটদের দিয়েছেন যতটুকুতে তাদের নিশ্চিন্ত জীবনের কাঠামো বেশি ক্ষুণ্ণ না হয়। যেমন, নিম্নশ্রেণির জীবনযাপন সম্পর্কে লেখকদের যে কৌতূহল, তার বশে তাঁরা ছোটদের ঝগড়ুর কাছে অবিশ্বাস্য সব গল্প শুনতে অনুমতি দিতে পারেন, কিন্তু ডেভিড কপারফিল্ডের মতো করে তাকে মিস্টার পেগটির বাড়ি গিয়ে থাকতে দিতে পারেন না। বাংলা সাহিত্যে হাকলবেরি ফিন তৈরি হয় না। স্বপ্নকে কিছুটা উড়তে দেওয়া গেলেও, ঘর, পরিবার এবং সামাজিক ভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠাই চূড়ান্ত লক্ষ্মণরেখা।

ছোটদের সাহিত্য নিয়ে এত বিস্তৃত আলোচনা আমাদের দেশে খুব বেশি হয়নি। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ জাতীয় সাহিত্যের মনোজ্ঞ গবেষণার পরিসর ছিল তুলনায় অনেক সংক্ষিপ্ত, মূলত ঔপনিবেশিকতাবাদকেন্দ্রিক। নিবেদিতা সেনের বিষয় বিস্তৃতি তাঁর কাজের সবলতাও বটে আবার দুর্বলতাও। বাংলা সাহিত্যভাণ্ডার এতই সমৃদ্ধ যে পুরো বিশ শতক ধরে আলোচনা করতে গেলে অনেক অনুল্লেখ, খামতি থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে কিছু অনুল্লেখ বা ভ্রান্তি নিয়ে সমস্যা হয়। সমাপ্তিতে সমঝোতার ছক নিয়ে পাশ্চাত্যের তুলনা প্রসঙ্গে ইন্দ্রনাথের কথা কেন ওঠে না (অন্য প্রসঙ্গে এলেও)? আবার, খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘ভোম্বল সর্দার’-এও লেখক শেষ পর্যন্ত পরিচিত ছকটি খুঁজে পান। জানান, ভোম্বল সর্দার যখন অবশেষে টাটানগর ফ্যাক্টরির সামনে পৌঁছয়, তখন প্রকাণ্ড লোহার গেটের সামনে বসে সে বোঝে যে সব অনুশাসন থেকে সে বারবার পালিয়েছে তার থেকে অনেক কঠিন দাসত্ব এই শিল্পনগরীতে অপেক্ষা করে আছে। এরকম একটা শেষ হয়ত লেখকের প্রতিপাদ্যকে জোরালো করে কিন্তু কাহিনির প্রতি সুবিচার করে না। কারণ আমরা পড়ি, ভোম্বল পথের ধারে বসে মুগ্ধ চোখে সিংহদ্বারের দিকে তাকিয়ে ভাবে— ‘কোন্‌ মন্ত্রে ওই সিংহদ্বার দিয়ে তার আসা-যাওয়া হবে অবাধ? সেই কর্মমন্ত্রটি কে তাকে শেখাবে?’

আর একটা কথা। তাত্ত্বিক বিষয়ের বাহুল্য এবং কিছু বিভ্রান্তিকর উল্লেখ লেখকের মূল বক্তব্যকে কিছুটা অস্পষ্ট করেছে। তবে খামতি যাই-ই থাক, এই গবেষণায় এতগুলো বিষয় এসেছে যে কিশোর সাহিত্য নিয়ে উৎসাহী গবেষকরা এগনোর পথ পাবেন। আর পাঠকরা আরেক বার ছোটবেলার ভাললাগাগুলোকে ফিরে দেখার সুযোগ পাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE