Advertisement
E-Paper

বলা যেতে পারে, কেবল মেঘের আড়াল সরল

শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত যেন সব অর্থেই বাংলা অলঙ্করণ শিল্পের জগতে এক ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এই ব্যতিক্রমী মহারথীর বিপুল সৃজন-বিবরণ কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই গ্রন্থ-স্থাপত্য বাংলার শিল্পকলার ইতিহাসে বিরল সংযোজন।

দেবদত্ত গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
সুবোধ দাশগুপ্ত/ অলঙ্করণ ইত্যাদি। সম্পা. সন্দীপ দাশগুপ্ত। লালমাটি, ৬০০.০০

সুবোধ দাশগুপ্ত/ অলঙ্করণ ইত্যাদি। সম্পা. সন্দীপ দাশগুপ্ত। লালমাটি, ৬০০.০০

শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত যেন সব অর্থেই বাংলা অলঙ্করণ শিল্পের জগতে এক ‘মেঘে ঢাকা তারা’। এই ব্যতিক্রমী মহারথীর বিপুল সৃজন-বিবরণ কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া এই গ্রন্থ-স্থাপত্য বাংলার শিল্পকলার ইতিহাসে বিরল সংযোজন। স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন ছিল না শিল্পীর, এমনকী ছিল না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষাও। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য ছিল তাঁর রেখা ও তুলির টানে, আর শিল্পশিক্ষা ছিল তাঁর মননে। মনন আর বোধ দিয়েই তিনি তাঁর মুকুটে একের পর এক সোনার পালক গেঁথেছিলেন। বড় সহজ ছিল না সেই সোনার পালক চয়ন করা। যে যুগে কাজ করেছেন সুবোধবাবু, সে যুগে কম্পিউটার, ফটোশপের সুবিধা ছিল না। হাতে ছিল না টাইপোগ্রাফির হাজারগণ্ডা বাজারি নমুনাও। ছাপাছাপির জগৎটাই ছিল সীমাবদ্ধ। সেই সীমাবদ্ধতাকেই কী বিপুল বৈচিত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন এই শিল্পী, তারই পরিচয় এই বই।

প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ, কার্টুন, শীর্ষচিত্র, লেখাঙ্কন, আর্টওয়ার্ক সর্বত্রই সীমাবদ্ধতাকে হার মানানোর কারিগর সুবোধ দাশগুপ্ত। বইয়ের পাতায় পাতায় সেই সব দুর্লভ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সূত্রগুলি সযত্নে বিধৃত। ‘প্রকাশনা শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গ্রন্থসজ্জা, প্রচ্ছদ-নির্মাণ, লিখন-শিল্প ও সচিত্রকরণ’-এর প্রত্যেকটি পদক্ষেপে স্থান-কাল-পাত্র বুঝে, নিজস্বতাকে অক্ষুণ্ণ রেখেও যে শৈলী বদলের দক্ষতা দেখানো যায়, সেটাই করে দেখিয়েছিলেন তিনি। সেই নিরিখে দেখতে গেলে হয়তো বলতে হবে, সুবোধবাবুকে নিয়ে একটিমাত্র গ্রন্থনির্মাণ যথেষ্ট নয়। বলা যেতে পারে, এটিতে কেবল নথিকরণ হল। বলা যেতে পারে, মেঘের আড়াল সরল। কিন্তু এই স্থাপত্য দাবি করছে এমন মানুষের জীবন ও কর্ম অন্যান্য মাধ্যমে বাহিত হওয়ার কথা। যদি অন্য মাধ্যমের কলাকুশলীরা এগিয়ে আসেন তবেই কিন্তু এমন নির্মাণের সার্থকতা। তবেই কিন্তু কলঙ্কমোচন হয়।

এই বইতে সুবোধবাবুর নিজের একটি লেখা রয়েছে। লেখাটির নাম ‘মুখপোড়ার আত্মদর্শন’। যিনি নিজে বলছেন, ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি উড়ছিল। পেটকাটি, চৌরঙ্গি, শতরঞ্জ, মুখপোড়া, ময়ূরপঙ্খী, চাঁদিয়াল আরও কত কী তার সব নামও জানি না। আমি ওই ঘুড়িদেরই একজন ছিলাম। হঠাৎ একদিন ভোকাট্টা হয়ে মুখপোড়া মুখ থুবড়ে পড়লাম কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ার ছাদে। আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে গেল। চারিদিকে বই আর বই। কত বাহার, কত রঙ। চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার জোগাড়। একটা একটা করে বইগুলো হাতিয়ে দেখতে লাগলাম আর সামনের বন্ধ দরজাগুলো একটা একটা করে খুলে যেতে লাগল।’ জীবনের সঙ্গে কথাগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাত্রা দেখা, স্কুলে না গিয়ে শ্যামবাজারের বাসে উঠে হলিউডের সিনেমা দেখতে যাওয়া, বাঁশি বাজানোর নেশা আর সর্বোপরি ছবি আঁকাকে জীবন পাঠ্যে আবশ্যিক করা এমনই ছিল তাঁর জীবনবোধ। এমন জীবনে গল্পকার গল্প পেতে পারেন কিংবা চলচ্চিত্রনির্মাতারা অনায়াসে খুঁজে নিতে পারেন হাজার পাতার চিত্রনাট্য।

যাদবপুর আর কাঁচড়াপাড়ার টিবি হাসপাতালের বন্দি জীবনেই ছবি আঁকার সঙ্গে সখ্য। তার ফল হল সুদূরপ্রসারী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেরানির চাকরি প্রত্যাখ্যান করে বেছে নিলেন ছবি আঁকার রুক্ষ রাস্তা। আর্থিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে বেছে নিলেন সচিত্রকরণের কাজ। ‘যুগান্তর’ থেকে ‘আনন্দবাজার’ পর্যন্ত এক দীর্ঘ যাত্রা পথ। প্রথম প্রচ্ছদ বিমল করের কাচঘর বইয়ে। এই দীর্ঘ যাত্রার পর্বে পর্বেই প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের শিল্পীজীবনের বৈচিত্রময় বিশিষ্টতাকে।

বইটিতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বিমল কর, বাদল বসু, সমরেশ মজুমদার, রণেনআয়ন দত্ত, প্রণবেশ মাইতি, হিরণ মিত্র, দেবব্রত ঘোষ, সুব্রত চৌধুরী, দেবাশীষ দেব, শৈলেন ঘোষ, সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত, অমল চক্রবর্তী সহ অনেকেই নানা দিক থেকে সুবোধবাবুর জীবন, কর্ম ও শৈলীর আলোচনা করেছেন। বেশ কয়েকটি আলোচনা ব্যক্তি সুবোধের নানা দিক নিয়ে। সঙ্গে তাঁর নিজের লেখাগুলি তো আছেই। নিজের লেখার মধ্যে দেশভাগ ও দাঙ্গা বিষয়ক অভিজ্ঞতার যে ছবি তিনি এঁকেছেন তা ‘ন্যারেটিভ আর্ট’-এর গুণ সমৃদ্ধ। পাশাপাশি পঞ্চাশের দশকে যখন নিজের উদ্যমে তিনি ছবি আঁকার নিজস্বতাকে প্রতিষ্ঠা করছেন তখন দেশবিদেশের শিল্পীদের ছবি দেখার অভ্যাস তাঁর ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকেই নির্মিত হচ্ছে ভাঙাচোরা রূপবিন্যাস, রুক্ষ ও শক্তিশালী রেখার ব্যবহারে এক চঞ্চল শৈলী। কোথাও যেন ফর্মগুলো নিজের জীবন আর সময়ের সঙ্গে বা পঞ্চাশের দশকের সঙ্গে এক হয়ে যেতে চায়। অথচ অলঙ্করণের পর্বে পর্বে শূন্য জমি বা ‘ব্ল্যাঙ্ক স্পেস’-এর বিপুল দাপট। দেবাশীষ দেব নিপুণ ভাবে লক্ষ করেছেন, ড্রইং-এর ডিস্টরশন, কাটাকুটির টেক্সচার, ভূতুড়ে চেহারা আর ছবির গ্রটেস্ক ভাব। এই বিশ্লেষণগুলি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। যেমন সৌম্যেন পাল ধরিয়ে দিচ্ছেন ছোটদের অলঙ্করণে শিল্পী কী ভাবে শিশুমনের কল্পনাতে ছাপ ফেলার সূত্র রেখে গিয়েছেন। সিলুয়েট, হাফটোন, ব্লক ব্যবহার ইত্যাদির কৌশলে অলঙ্করণে কত না বৈচিত্র এনেছেন শিল্পী।

ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় গল্পের টেক্সটকে ছবির ভাষায়, রেখার ভাষায় সম্প্রসারিত করতেন শিল্পী। যেমন ‘আনন্দমেলা’য় (১৯৭৩) প্রকাশিত লীলা মজুমদারের ‘নন্দগুপি’। দু’জনের সম্পর্কের (ছাগল ও বাচ্চাটির) প্রসঙ্গ বোঝাতে শিল্পী বাচ্চাটির প্রতিকৃতির মধ্যে ছাগলের অবয়বের আদল মিশিয়ে দিয়েছেন। অথবা ওই একই ‘আনন্দমেলা’য় মনোজ বসুর ‘পালোয়ান ভূত’ গল্পে বিধবা মাতঙ্গী ঠাকরুণের যে ছবি এঁকেছেন তাতে রেখা যেন আগুনের শিখার মতো তরঙ্গায়িত ছন্দে বাহিত। এ যেন লেখকের কথাকেই প্রতিষ্ঠা করে, ‘রাগে তার গা যেন আগুনের মতো গরম।’ সচিত্রকরণের এমন দুর্লভ বৈশিষ্ট্য বিরল। পাশাপাশি এসেছে তাঁর প্রচ্ছদ প্রসঙ্গ, তাঁর দৃশ্য স্মৃতিকে দৃশ্যে রূপান্তরিত করার প্রসঙ্গ সহ নানা দিক। পাইকা, বর্জাইস প্রেস টাইপের আড়ষ্টতা ভেঙে শিল্পী যে ভাবে হাতে লিখেছেন বইয়ের নাম বা লেখকের নাম তা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। লেটারিং-নির্ভর টাইপোগ্রাফিক মলাট এঁকে তিনি যে মলাটশিল্পের দিকবদল ঘটিয়েছিলেন তা বোঝা যায় সোমনাথ ঘোষের লেখা থেকে।

সব শেষে দুটো কথা। এখানে অসংখ্য ছবি আছে যার সঙ্গে কিছু প্রাসঙ্গিক পরিচিতি থাকা জরুরি ছিল। তা না হলে তথ্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। দ্বিতীয়ত এই বিপুল কাজটি ফলিত শিল্প বিভাগের ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের গোচরে আসা দরকার। কারণ সচিত্রকরণ জগতে সুবোধ দাশগুপ্ত তো নিজেই এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।

Clouds
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy