হিঙ্গোরানি পাঠককে বার বার মনে করিয়ে দিতে চাইছেন কাশ্মীরের নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অদূরে সোভিয়েত রাশিয়ার অবস্থান এবং তার আগ্রাসী ভঙ্গি ব্রিটিশদের শঙ্কিত করেছিল। ফলে ভারতের স্বাধীনতা যখন প্রায় অনিবার্য তখন কাশ্মীর যাতে কোনও দুর্বল বা বশংবদ প্রশাসনের হাতে থাকে তা নিশ্চিত করতে চাইছিল তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন। নেহরুর ভারতের থেকে জিন্নার পাকিস্তানের কাছেই সেই বিশেষ সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই পরিকল্পনা মাফিক কাশ্মীর সমস্যাটি তৈরি করেছে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন। পাক-আগ্রাসন, ভারতীয় সেনার কাশ্মীরে যুদ্ধে নামা, যুদ্ধবিরতি হয়ে যা গড়িয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জে।
কী ভাবে ধাপে ধাপে কাশ্মীরে সমস্যাটি নির্মাণ করা হয়েছে তা দেখাতে বহুচর্চিত এবং বিতর্কিত ইতিহাসকে ব্যবহার করেছেন হিঙ্গোরানি। পাক মদতপুষ্ট হামলাকারীদের সামনে যখন কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহের সিংহাসন টলমল তখন সেনা পাঠায় ভারত। কিন্তু তার আগে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকশেসন’-এ কাশ্মীরের ভারতভুক্তি নিয়ে জনগণের মত নেওয়ার বিষয়টি ঢুকিয়ে দেন ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভারতীয় সেনা পুরো কাশ্মীর থেকে হামলাকারীদের হঠিয়ে দেওয়ার আগেই যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটেন ভারতীয় সেনার দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ জেনারেলরা। এর পরে মাউন্টব্যােটনের পরামর্শে বিবাদটি রাষ্ট্রপুঞ্জের দরবারে নিয়ে যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। যা শেষ পর্যন্ত কাশ্মীরে গণভোটের প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক সিলমোহর দেয়।
হিঙ্গোরানি এই গণভোটের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন আর ১৯৪৭-এর ভারতের স্বাধীনতার আইনের কাঠামোর মধ্যে রাজন্যশাসিত অঞ্চলগুলির শাসকরা নিজের ইচ্ছেমতো পাকিস্তান বা ভারতে যোগ দিতে পারেন। প্রজাদের অভিমত নেওয়ার কোনও প্রয়োজন বা সুযোগ সে আইনে নেই। ফলে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকশেসন’-এ জনগণের মত নেওয়ার কোনও আইনি ভিত্তি নেই। হিঙ্গোরানি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতের সংবিধান তৈরি হওয়ার পরে গণভোটের দাবি অসাংবিধানিক।
কাশ্মীর সমস্যাকে রাষ্ট্রপুঞ্জে নিয়ে যাওয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি, এর দায় অনেকাংশে নেহরুর উপরেই চাপিয়েছেন। পাকিস্তান, ব্রিটেন, বিশেষ করে মাউন্টব্যাটেনের এই ছকটি নেহরু কেন ধরতে পারেনি সেই প্রশ্নও উঠেছে। নেহরুর আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার দিকেও প্রচ্ছন্নে কটাক্ষ করেছেন হিঙ্গোরানি। সমালোচনার এই ঘরানাটি কিন্তু নতুন নয়। নেহরুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে ভাবা দরকার নেহরু প্রথমে কেন গণভোটের দাবি মেনেছিলেন। কাশ্মীরে তখন শেখ আবদুল্লার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। নেহরুর সঙ্গে শেখ আবদুল্লার ঘনিষ্ঠতাও ছিল। তাই কি নেহরু গণভোটের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন? পরে রাষ্ট্রপুঞ্জের রাজনীতির খেলায় বিরক্ত হয়েই কি নেহরু গণভোটের প্রস্তাব থেকে পিছিয়ে এলেন, না কি অন্য কোনও আশঙ্কা কাজ করেছিল? না, সেই প্রশ্নের উত্তর দেননি হিঙ্গোরানি। তিনি চলে গিয়েছেন সমাধানের পথ খুঁজতে।
রাজনীতির কথা প্রথমে বাদই দিয়েছিলেন হিঙ্গোরানি। সামরিক অভিযান, কূটনীতির পথেও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করেন তিনি। তিনি ফিরে যেতে চান রাষ্ট্রপু়্ঞ্জেই। তাঁর মতে, ভারতের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে কাশ্মীর বিষয়টি আবার তোলা। কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে আইনি যুক্তির পথটিও সাজিয়ে দিয়েছেন। যে পথে দেখানো সম্ভব কাশ্মীরে গণভোটের যৌক্তিকতা নেই, এবং তা ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। সংবিধানের কাঠামোর বাইরে কোনও সমাধানে আগ্রহী নন লেখক। আইনি পথেই পাক-অধিকৃত কাশ্মীরেরও ভারতের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
তর্কের খাতিরে যদিও ধরে নেওয়া যায় রাষ্ট্রপুঞ্জের আদালতের রায় ভারতের পক্ষেই যাবে তা হলেও কি তা বাস্তবে কার্যকর হবে? পাকিস্তান কি মানবে? ভারত নিজেই তো এত দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাব মানেনি। নিরাপত্তা পরিষদে পাস হওয়া অনেক প্রস্তাব তো ইজরায়েল তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। কিছু দিন আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জের আদালত দক্ষিণ চিন সাগরের অধিকার নিয়ে ফিলিপিন্সের পক্ষে রায় দিয়েছিল। রায় মানবে না সাফ জানিয়ে দিয়েছে চিন। ফলে হিঙ্গোরানি প্রস্তাব ফলপ্রসূ হওয়া কার্যত অসম্ভব।
অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন। কাশ্মীরে গিয়ে বাজপেয়ী বলেছিলেন মানবিক দৃষ্টিতে সমাধান খুঁজতে হবে। হিঙ্গোরানির বইয়ে সেই মানবিকতার সন্ধান মেলে না। যেমন মেলে না মোদীর কাশ্মীর নীতিতেও।