Advertisement
E-Paper

নতুন সমাজ, নতুন সমাজদর্শন

অধ্যাপক প্যারির মূল তত্ত্ব দিয়েই শুরু করা যাক। তাঁর মতে, ভারতীয় সমাজের স্তর বিভাজন এখন আর জাতের অক্ষরেখাকে কেন্দ্র করে হয় না।

দীপঙ্কর গুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২০ ০০:০১

ভারতের সমাজ আমূল পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু এখনও অনেকে জাতপাত, শ্রম, গ্রাম এবং সামাজিক সম্পর্কের মতো বিষয়ে সনাতনি ধ্যানধারণা আঁকড়ে আছেন। আশার কথা, অধ্যাপক জনাথন পি প্যারির এই বইটা তাঁদের মন এবং মত পাল্টানোর কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। বইটি এ কাজে এমন উপযুক্ত হয়ে উঠেছে বিশ্লেষণাত্মক বিষয়বস্তুর গুণে। সেই বিশ্লেষণকে বলিষ্ঠ করেছে নিবিড় ক্ষেত্রসমীক্ষার খতিয়ান। ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টে প্রায় তিন দশক সময় ধরে এই তথ্য সংগৃহীত। কাজের ক্ষেত্র বাছাইটিও জবর। ভিলাই টাউনশিপে থেকে সমীক্ষাটি করার ফলে একটি একক অবস্থানের মধ্যে নগরায়ণ, পরিযাণ, শ্রেণি ও সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেকার সম্পর্কগুলিকে খুব কাছ থেকে পরখ করে দেখা সম্ভব হয়েছে।

অধ্যাপক প্যারির মূল তত্ত্ব দিয়েই শুরু করা যাক। তাঁর মতে, ভারতীয় সমাজের স্তর বিভাজন এখন আর জাতের অক্ষরেখাকে কেন্দ্র করে হয় না। এখন এই ভাগ শ্রেণিকেন্দ্রিক। এই অবস্থানটি কিন্তু কোনও রাজনৈতিক মতবাদের প্রতি বিশ্বস্ততাপ্রসূত নয়, এর পিছনে অতি পরিশ্রমসাধ্য ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্যের সমর্থন রয়েছে। বিভিন্ন বাস্তব উদাহরণ ব্যবহার করে অধ্যাপক প্যারি তাঁর অবস্থানের বৈধতার প্রমাণ দিয়েছেন।

বিয়ের কথাই ধরুন। হিন্দুদের বিয়েতে জাতের বিচার বরাবরই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভিলাই ইস্পাত কেন্দ্রের কর্মীদের মধ্যেও তা-ই, তবে একটা পার্থক্য আছে। এঁদের প্রথম বিয়েটা ঐতিহ্য মেনেই হয়। কিন্তু ক্ষেত্রসমীক্ষার তথ্য বলছে, এই জনগোষ্ঠীতে অনেকেরই বিবাহের সংখ্যা একাধিক। দ্বিতীয় বিয়েটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রেম-ভালবাসাভিত্তিক পরিণয়। সেই দ্বিতীয় বিয়েতে জাতের ভূমিকা নেই বললেই চলে।

ক্লাসেজ় অব লেবার: ওয়ার্ক অ্যান্ড লাইফ ইন আ সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান স্টিল টাউন
জনাথন পি প্যারি
সোশ্যাল সায়েন্স প্রেস, দিল্লি, ২০১৯

নিজেদের মধ্যে খাওয়াদাওয়ার সময়ও জাত নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না। শুধু তথাকথিত বর্ণহিন্দুরা তফসিলি জাতিভুক্ত সৎনামীদের সঙ্গে খাওয়ার বেলায় লক্ষ্মণরেখা টেনে রাখেন। কারখানার ভিতর টিফিন বিরতিতে খেতে বসলে এটুকু বাদে আর কোনও জাতিভিত্তিক বিভাজন চোখে পড়ে না। লাঞ্চবক্স খুলে সবাই একসঙ্গেই বসে খান। সমাজতত্ত্বের প্রচলিত কেতাবগুলির সঙ্গে যাঁদের কম-বেশি পরিচিতি আছে, তাঁরাই জানবেন, সেই সব বইয়ে হিন্দুদের মধ্যে খাওয়ার সময়ে জাতভিত্তিক বিভাজনের কথা কী বিপুল গুরুত্ব পেয়েছে।

তার মানে এই নয় যে, ভিলাইয়ের শ্রমজীবী সমাজ থেকে শ্রেণিভেদ উবে গিয়েছে। পুরনো বিভাজিকাগুলি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, পরিবর্তে মাথা তুলেছে বৈষম্যের নতুন ব্যাকরণ। এই নতুন বিভাজিকার মধ্যে প্রবলতম হল চাকরির স্থায়িত্বের মাপকাঠিতে শ্রেণিবিন্যাস। যাঁদের বাঁধা ‘চাকরি’ আছে, আর যাঁদের স্থায়ী জীবিকা নেই— অর্থাৎ যাঁরা কারখানার ঠিকা শ্রমিক— তাঁরা দুটো সম্পূর্ণ পৃথক শ্রেণি।

যাঁদের স্থায়ী চাকরি নেই, চাকরিতে বহাল কর্মী-সমাজ তাঁদের ঘেন্না করেন। এতটাই যে, ঠিকা শ্রমিকদের সঙ্গে করমর্দনেও তাঁদের তীব্র অনীহা। চাকরিজীবীদের ট্রেড ইউনিয়নগুলি এই ঠিকা শ্রমিকদের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ মেলাতে নারাজ। ঠিকা শ্রমিকদের আন্দোলনে পাকা চাকুরেদের শ্রমিক সংগঠনকে পাশে পাওয়া যায় না। তাই ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজগুলি চুক্তিভিত্তিক ঠিকা শ্রমিকদের বরাতেই জোটে।

শ্রমজীবী মানুষগুলির সামাজিক জীবনেও এই ভেদাভেদের প্রভাব পড়ে। যাঁদের চাকরি আছে, তাঁদের ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যায়। ঠিকা শ্রমিকদের সন্তানদের কাছে সুশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ অধরাই থেকে যায়। লেখক উল্লেখ করেছেন, বর্তমানের পাকা চাকরির সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। যাঁদের ভাল চাকরি আছে, তাঁরা ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার দিকে নজর দিতে পারেন, রিয়্যাল এস্টেট ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে অবসর জীবনটা সুখে কাটানোর বন্দোবস্তও করে রাখেন।

কাজেই ‘লেবার অ্যারিস্টোক্র্যাট’ ও অন্যান্যের মধ্যে পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। ম্যানেজমেন্টও বিলক্ষণ সেই খবর রাখে। অনুগত ট্রেড ইউনিয়নকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে এই শ্রেণি ব্যবধানকে জাগিয়ে রাখে সর্বদাই। মজার কথা হল, কারখানার কোনও পাকা কর্মী অবসর নিলে তাঁর জায়গায় সাধারণত নতুন কোনও পাকা কর্মী নিযুক্ত হন না, সেই কাজ করেন কোনও ঠিকা শ্রমিক।

ভিলাইয়ের এই চাকুরেদের বাড়ির তুলনায় ঠিকা শ্রমিকদের ঘরে আত্মীয়-পরিজনের টান জোরালো। যাঁদের চাকরি আছে, তাঁদের ভবিষ্যতের সুরক্ষাও আছে। তাই এঁদের আত্মীয়স্বজনের উপর বেশি নির্ভর করার দরকার নেই। ঠিকা মজুরদের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য রকম। তাঁদের কাছে আত্মীয়বন্ধন ভীষণ জরুরি। কারণ তাঁদের চাকরি, জীবন অনিশ্চিত। তাঁকে বিমার মতো করেই নিরাপত্তার আচ্ছাদন জোগায় পারিবারিক সম্পর্কগুলির সহযোগিতা। তাই যদি কারও মনে প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় শ্রমিকেরা পরিবারের উপর কেন এত নির্ভর করেন, তার উত্তর এখানেই।

আমি যখন বইটা পড়ছিলাম, তখন লকডাউনের ঠিক পরে রাস্তায় পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নেমেছে। তাঁদের দুর্দশা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাল, যদি ভারতীয় মজদুর শ্রেণির ধরাবাঁধা চাকরি থাকত, তবে তাঁরা পরিবারের সঙ্গে একত্র হতে এমন মরিয়া হয়ে উঠতেন না। যখন বিষয়টা নিয়ে আরও একটু খতিয়ে দেখলাম, বুঝলাম যে, যাঁরা বাড়ির পথে হেঁটে চলেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে পরিযায়ী। এঁদের ‘চাকরি’ নয়, ঠিকা কাজ ছিল। কর্মক্ষেত্রে সম্মানের এই তারতম্য কত মর্মান্তিক হয়ে উঠতে পারে!

একটিমাত্র বই এতখানি কাজের হয়েছে অধ্যাপক প্যারির পাণ্ডিত্যের কৃতিত্বে। প্রখর প্রত্যয় ও প্রামাণ্য সহযোগে সমাজতত্ত্বের একাধিক প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছোট শহর ও নগরে জনসংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে বলেই আজ পরিবর্তনের অভিমুখটাও খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঝরা পাতাগুলো পুড়িয়ে এ বার চিন্তার ডালিটি নবরূপে সাজানোর পালা।

Book Review Jonathan Parry
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy