Advertisement
১১ অক্টোবর ২০২৪

তাড়া করেছিল মিউটিনির ভূত

গত একশো বছরের ইতিহাস চর্চায় জালিয়ানওয়ালা বাগ গণহত্যাকে সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা হয় ‘শেষের শুরু’ বলে।

স্মৃতিসৌধ: জালিয়ানওয়ালা বাগের সেই বধ্যভূমিতে এখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাড়ম্বর উদ্‌যাপন। ছবি: এএফপি

স্মৃতিসৌধ: জালিয়ানওয়ালা বাগের সেই বধ্যভূমিতে এখন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাড়ম্বর উদ্‌যাপন। ছবি: এএফপি

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০২
Share: Save:

দিল্লির বিড়লা হাউসে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মুখোমুখি হন মহাত্মা গাঁধীর নাতি তুষার গাঁধী ও রাওলাট-আইন প্রণেতা সিডনি রাওলাটের নাতির ছেলে জাস্টিন রাওলাট। জাস্টিন তখন দিল্লিতে বিবিসি’র সাউথ এশিয়া করেসপন্ডেন্ট। তুষার কিছু তিক্ত মন্তব্য করতে পারেন, আশঙ্কায় ছিলেন জাস্টিন। উল্টোটাই ঘটল। তুষার গাঁধী হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘[ব্রিটিশ] সাম্রাজ্যের কফিনে প্রথম পেরেকটা ঠোকার জন্য আপনার প্রপিতামহেরই প্রশংসা প্রাপ্য।’’

এ মন্তব্য অবশ্য ব্যতিক্রমী নয়। গত একশো বছরের ইতিহাস চর্চায় জালিয়ানওয়ালা বাগ গণহত্যাকে সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা হয় ‘শেষের শুরু’ বলে। এক দিকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেদন-নিবেদনের পর্ব পেরিয়ে সরাসরি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলনে উত্তরণের সঙ্গে এই আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে গাঁধীজির প্রতিষ্ঠা, অন্য দিকে ন্যায়নীতির ধ্বজাধারী ব্রিটিশ শাসকের মুখোশ চূড়ান্ত ভাবে খুলে যাওয়ার পর তাদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ এবং শেষাবধি ব্যর্থ চেষ্টা। এই কারণেই এ পর্যন্ত জালিয়ানওয়ালা বাগ সংক্রান্ত বইপত্রে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, দেশবিদেশের প্রতিক্রিয়া এবং রাজনীতির টানাপড়েন। কিন্তু কিম ওয়াগনার তাঁর আলোচ্য বইয়ে বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন উল্টো দিক থেকে। তাঁর মতে, ঘটনাটি আসলে এক দীর্ঘায়িত প্রক্রিয়ার অন্তিম পর্যায়— যে প্রক্রিয়ার সূচনা ছয় দশক আগে, ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহে। বস্তুত বিশ শতকের গোড়াতেও ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়ার পিছনে কাজ করে চলছিল সেই সিপাহি বিদ্রোহের স্মৃতি। তাই ওয়াগনারের চোখে, জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনা ‘মিউটিনি’-তাড়িত উনিশ শতকীয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতারই অন্যতম ফসল।

জালিয়ানওয়ালা বাগে সে দিন ঠিক কী ঘটেছিল? আজ তার পুনর্নির্মাণ নিতান্তই কঠিন। আকর সূত্র যা পাওয়া যায় সবই ঘটনার পরে লেখা, বলা ভাল ঘটনাটি বিতর্কিত হয়ে ওঠার পরে লেখা। সরকারি ‘ডিসর্ডার্স এনকোয়্যারি কমিটি’ (হান্টার কমিটি) এবং বেসরকারি ‘কংগ্রেস পঞ্জাব এনকোয়্যারি’— সমান্তরালে চলা এই দুই তদন্তের সূত্রে সংগৃহীত ও প্রকাশিত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও রিপোর্টই আজ পর্যন্ত অধিকাংশ আলোচনার মূল ভিত্তি। হান্টার কমিটি শুধু ঔপনিবেশিক প্রশাসনে যুক্ত ব্রিটিশ ও ভারতীয় অফিসারদের সাক্ষ্য নিয়েছিল, সাধারণ ভারতীয়দের অভিজ্ঞতা ও দুর্দশার কোনও ইঙ্গিতই সেখানে নেই। আবার কংগ্রেসের তদন্ত শুধু স্থানীয় অধিবাসী ও সাধারণ ভারতীয়দের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে হয়েছিল। পড়লে মনে হবে, দুটো যেন আলাদা ঘটনার রিপোর্ট। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের যে ছবি আজ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে, তার পিছনে অনেকটা ভূমিকাই রিচার্ড অ্যাটেনবরো-র ‘গাঁধী’ (১৯৮২) ছবির। সেখানে গাঁধীজির অহিংস সত্যাগ্রহের গুরুত্ব প্রতিপাদনে এ যেন শুধুই এক ঔপনিবেশিক নৃশংসতার মুহূর্ত নির্মাণ, বিশ্ব জুড়ে এমন আরও অনেক ঔপনিবেশিক হিংসার ঘটনার মতো এটিও ‘একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’: দশ থেকে কুড়ি হাজার লোকের জমায়েতে দশ মিনিটে ১৬৫০ রাউন্ড বুলেটে সরকারি হিসেবে ৩৭৯ জন নিহত। কেন গুলি চালালেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার? হঠাৎই কি তাঁর মাথায় ঔপনিবেশিক নৃশংসতা চাড়া দিল? গাঁধীর আন্দোলনে ব্রিটিশ প্রশাসন কি এতটাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল? নাকি ডায়ার নিজেই যেমন বলেছেন, জনতার বিপুল সংখ্যা তাঁকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল? সে দিনের ব্রিটিশ প্রশাসনের ভয় ও আশঙ্কার মাত্রার সঙ্গে অমৃতসর গণহত্যার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাকে মেলানো খুব মুশকিল। তবু বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এই ঘটনার আগের ঘটনাবলির মধ্যে দিয়ে কী ভাবে এগোচ্ছিলেন, কেমন ছিল তাঁদের প্রতিক্রিয়া— সে দিকে নজর ফেরালে হয়তো পরিণতির চিত্রটা আমাদের কাছে কিছুটা স্পষ্ট হতে পারে। এই বইয়ে ওয়াগনার সফল ভাবে সেই চেষ্টাই করেছেন।

জালিয়ানওয়ালা বাগ/ অ্যান এম্পায়ার অব ফিয়ার অ্যান্ড দ্য মেকিং অব দি অমৃতসর ম্যাসাকার
কিম এ ওয়াগনার
৫৯৯.০০, পেঙ্গুইন ভাইকিং

১৮৫৭-র অভ্যুত্থানের পরিণতিতে কোম্পানির বিসর্জন হল, কিন্তু ‘রাজ’অহং থেকেই গেল। পরের অর্ধশতকে একের পর এক ঘটনায় তার প্রমাণ মিলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য ব্যবসাবাণিজ্য চৌপাট, ১৯১৭-য় অতিবৃষ্টি, সঙ্গে ম্যালেরিয়া আর প্লেগ মহামারি। ১৯১৮-য় অনাবৃষ্টি, খাদ্যাভাব আর ফ্লু মহামারিতে দশ লক্ষের উপর মৃত্যু। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার প্রত্যাশিত স্বস্তি দিতে পারল না। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয়দের মধ্যে বিক্ষোভ জমতে লাগল। আগুনে ঘি ঢালল চূড়ান্ত দমনমূলক রাওলাট আইন। বিক্ষোভের সামান্য প্রকাশকেই ধরে নেওয়া হল বিদ্রোহের ইঙ্গিত, তা সে গাঁধীজি-অনুপ্রাণিত অহিংস হরতাল-প্রতিবাদ হলেও। যাঁরা হয়তো অমৃতসরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারতেন, সেই ড. সত্যপাল ও সইফুদ্দিন কিচলুকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করে ধরমশালায় গৃহবন্দি করে রাখা হল। পরের ঘটনা তো বহু চর্চিত। ডায়ার ধরেই নিলেন, অমৃতসর তথা পঞ্জাব বিদ্রোহের জন্য ফুটছে। জালিয়ানওয়ালায় যারা জমায়েত হয়েছে— নারী ও শিশু সমেত— তারা সবাই দাঙ্গাবাজ, সুযোগ পেলেই আক্রমণ করবে। পরিস্থিতি সামলানোর বদলে তিনি ভারতীয়দের দিতে চাইলেন মনে রাখার মতো শিক্ষা— আর কখনও যেন তারা মাথা তোলার সাহস না করে। শুধু অমৃতসরের জন্য নয়, সারা পঞ্জাবের জন্য দৃষ্টান্ত চাই। তারই ফল নির্বিচার গুলিবর্ষণ। আদৌ আকস্মিক নয়, সম্পূর্ণ সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মেশিনগানবাহী গাড়িও নিয়ে গিয়েছিলেন ডায়ার, নেহাত সরু গলি তাই ঢোকাতে পারেননি, না হলে সেখানে সেটাই ব্যবহার করতেন বলে হান্টার কমিশনে নির্দ্বিধায় বলেওছিলেন তিনি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ওয়াগনার কোথাও কোনও খুঁটিনাটি বাদ দেননি। ১৩ এপ্রিলের ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাত্রপাত্রীদের কার শেষ পর্যন্ত কী হল, জানাতে ভোলেননি তাও। তার মধ্যে মনে থেকে যায় একজনের কথা— মিশনারি মার্সেলা শেরউড, যাঁর উপর মারাত্মক আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় অমৃতসরের কৌরিয়ানওয়ালা গলিতে বুকে হেঁটে চলার দাওয়াই দিয়েছিলেন জেনারেল ডায়ার। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে বিপন্ন উদ্বাস্তুদের ত্রাণের কাজে হাত লাগাতে সত্তর বছর বয়সি এই অবসরপ্রাপ্ত মিশনারি আবার ফিরে এসেছিলেন পঞ্জাবে। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রয়াত হন তিনি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE