E-Paper

নির্মাণ ভেঙে আবার গড়া

অভিনয় এবং নাট্যনির্মাণ দুই-ই তৈরি হয় কিছু কিছু আশ্চর্য, অকল্পনীয় আকস্মিকতায়। ‘কিছু কিছু’, সবটা নয়। সবটাই হঠাৎ অনুপ্রাণিত হয়ে করা যায় না। সবটাই শুধু আবেগ নয়।

ছকভাঙা: দেবী সর্পমস্তা নাটকের দৃশ্য।

ছকভাঙা: দেবী সর্পমস্তা নাটকের দৃশ্য। ছবি সৌজন্য: প্রণব বসু।

কৌশিক সেন

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৩৪
Share
Save

দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এই সময়ের এক জন অত্যন্ত শক্তিমান, প্রতিভাবান এবং গুরুত্বপূর্ণ নাট্যনির্দেশক। ‘সংসৃতি’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা এই গুণী শিল্পী চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসাবে, কখনও নাট্যপত্রের সম্পাদক হিসাবে, কখনও নাট্যবিষয়ক গদ্য রচনাকার হিসাবে, কখনও বা কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স ও থিয়েটার নিয়ে গবেষক হিসাবে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

আমার কাছে দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এক জন একনিষ্ঠ, পরিশ্রমী ও দক্ষ নাট্যনির্দেশক, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে নাট্যনির্মাণ প্রক্রিয়ার নানান জটিল ও সূক্ষ্ম স্তর নিয়ে পরীক্ষা করে যাচ্ছেন, তাঁর মতো করে। এই খোঁজ বা অন্বেষণ যে শুধুমাত্র তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছেন দেবেশ তা নয়। নিয়মিত নাট্যচর্চা ও নাট্যপ্রযোজনার মাধ্যমে হাতে-কলমে সেই ভাবনা ও তত্ত্বের সকল প্রয়োগ ঘটানোর নিরলস প্রয়াসও চালিয়ে যাচ্ছেন। সবচেয়ে আশার কথা, দেবেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজের নাট্য নির্মাণের ইতিবৃত্ত বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আমাদের জন্য— এবং যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আগামী প্রজন্মের নাট্যশিল্পীদের জন্য— একটি চমৎকার বইয়ের আকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। দেবেশের সৃজন পদ্ধতি, সিনোগ্রাফি নিয়ে ওঁর ভাবনা এত চমৎকার খুঁটিনাটি এই প্রকাশ পেয়েছে যে মুগ্ধ হতে হয়।

নাট্যনির্মাণ বিষয়ে দেবেশের ব্যক্তিগত অন্বেষণের সঙ্গে আমি সব জায়গায় একমত নই। প্রয়োগকৌশল যত ভিন্ন রকমের হবে ততই নাট্যকলা সমৃদ্ধ হবে। দেবেশের ভাবনার মধ্যে যেটা আমায় সবচেয়ে আকর্ষণ করেছে, তা হল ওঁর এই খোঁজটা। দেবেশ এক বারও বলার চেষ্টা করছে না যে এইটাই একমাত্র পথ বা পদ্ধতি, বরং ও আমরা যারা নাট্যচর্চা করে চলেছি দীর্ঘকাল ধরে, আমাদের সামনে ওর উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিচ্ছে। সেই অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে দীপক মুখোপাধ্যায়, সুদীপ সান্যাল, সঞ্চয়ন ঘোষ, সৌমিক-পিয়ালী, ময়ুখ-মৈনাক, বীরভূম বাঁকুড়ার লোকশিল্পীরা, সুদর্শন, অভিজিৎ আচার্য বা হিরণ মিত্রের মতো অসামান্য সব নেপথ্যের কবিদের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজকরতে গিয়ে।

নাট্যনির্মাণ: একটি ব্যক্তিগত অন্বেষণ

দেবেশ চট্টোপাধ্যায়

সম্পা: মলয় রক্ষিত

১২০০.০০

কারিগর

লেখাগুলো পড়লে বোঝা যায় দেবেশ কী ভাবে প্রতিনিধি, উইঙ্কল টুইঙ্কল হয়ে প্রথাগত (ওর ভাষায়) ভাবে শুরু করে একটু একটু করে পৌঁছল দেবী সর্পমস্তা-য়। দেবেশ ওর মতো করে দেখতে পেল স্পেস, স্পেস-এর গতিময়তা, আবিষ্কার করার চেষ্টা করল স্পেস-এর সঙ্গে অভিনেতার সম্পর্ক। জার্জ়ি গ্রটস্কি-র ‘পুয়োর থিয়েটার’ সারা পৃথিবীর নাট্য নির্মাতাদের মতোই অনুপ্রাণিত করল দেবেশকেও। একটা নাটক, তার ভিতর লুকিয়ে থাকা অনুভূতি একটা আঙ্গিক তৈরি করতে সমর্থ হয়। মিনার্ভা রেপার্টরি প্রযোজিত দেবী সর্পমস্তা নির্দেশক দেবেশের একটা ভিন্ন পরিচয় তৈরি করল। দর্শকরা আবিষ্কার করলেন লোকনাট্যের এক ভিন্ন ধরন। যে ধরনের মধ্যে তথাকথিত বিশুদ্ধতা হয়তো নেই, আছে এক অনুভূতিপ্রবণ মন যা শহুরে হয়েও আমাদের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে যায় মাটির কাছাকাছি।

অনুমান করি সবটাই সচেতন ভাবে, জেনে-বুঝে করা, কারণ এর পর দেবেশ ওর ভাষায় ‘বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুরের শিল্পীদের নিয়ে গিরিশ কারনাডের হয়বদন মঞ্চস্থ করে। শোভাবাজার নাটমন্দিরে সাইট-স্পেসিফিক নাট্য নির্মাণ করে। নিজের ভাবনাকে নানা উপায়ে ভেঙে-গড়ে এগিয়ে চলে। নাট্যশাস্ত্রের বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করতে গিয়ে দেবেশ এর পর প্রবেশ করে ওর ভাবনার আরও একটি স্তরে। ‘সিনোগ্রাফি’ শব্দটির সঙ্গে বাংলার থিয়েটারপ্রেমী দর্শকদের পরিচয় করাতে উদ্যোগী হয় দেবেশ। শুধু দর্শকরাই নন, বাংলা থিয়েটারের চর্চার ভিতরেও এই শব্দটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায় কারুবাসনা উপন্যাস আশ্রয়ে যে নাটক আমরা দেখেছিলাম, সেই নাটকে দেবেশ সিনোগ্রাফারের ভূমিকায় কাজ শুরু করে। বইতে ওই প্রযোজনার নির্মাণপর্বটি খুব চমৎকার ভাবে লেখা আছে। খুঁজতে খুঁজতে ধাক্কা খেতে খেতে স্পেস অভিনেতার শরীর, সঙ্গীতের ছন্দ, জীবনানন্দের কবিতা একটু একটু করে কী ভাবে বেড়ে উঠেছিল, সেই অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে আমাদের। এই ভাবে আরও পরিণত ভাবনায় জারিত হয়ে তৈরি হয় মাছি, তুঘলক, সওদাগরের নৌকো, চাঁদমনসার কিসসা।

এর পর এই বইতে আছে ভারী চমৎকার একটি পর্ব। এই পর্বে একটি নাটকের নির্মাণ পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অভিনেতার সংলাপের পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া। শুধু স্পেস নয়, সঙ্গীত নয়, আলোয় মঞ্চ ও অন্যান্য সামগ্রী নয়, এমনকি শুধু অভিনেতার শরীরটাই নয়, সংলাপও যাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অভিনেতাদের আত্মস্থ হয়ে ওঠে। যাতে আলাদা করে মুখস্থ না করে সে (অভিনেতা) গোটা নির্মাণপর্বের সঙ্গে যুক্ত থেকেই একটি ‘অর্গানিক প্রসেস’-এর মধ্যে দিয়েই সংলাপ আয়ত্ত করতে পারে। অর্থাৎ কী ভাবে অভিনেতার স্মৃতি সজাগ এবং সচেতন ভাবে জাগরূক থাকতে পারে। এমন নানান ভাবনায় সমৃদ্ধ এই বইটি। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন বহুগুণী শিল্পীরা।

অভিনয় এবং নাট্যনির্মাণ দুই-ই তৈরি হয় কিছু কিছু আশ্চর্য, অকল্পনীয় আকস্মিকতায়। ‘কিছু কিছু’, সবটা নয়। সবটাই হঠাৎ অনুপ্রাণিত হয়ে করা যায় না। সবটাই শুধু আবেগ নয়। দেবেশ চট্টোপাধ্যায় তাঁর মতো করে, তাঁর নিজস্ব ভাবনায় এক নির্মাণ বা প্রস্তুতি অর্জন করার পথে ব্রতী হয়েছেন, যা নাট্যদর্শকদের এবং আমাদের সকলের কাছে এক পরম প্রাপ্তি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review debesh chattopadhyay

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।