“বহুদিন ধরেই দেখছি যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করাটা সহজ, অনেক কবিতা ও গল্প লেখা হয়, কিন্তু প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সুতরাং এখানে প্রবন্ধের মূল যে বিষয়, অর্থনীতি, সেটা যে বাংলাতে ভালই আলোচনা করা সম্ভব তার একটা উদাহরণ আমি রাখার চেষ্টা করব।” ২০১৯ সালের অশোক রুদ্র স্মারক বক্তৃতার গোড়ায় এই কথাগুলো বলেছিলেন অধ্যাপক প্রণব বর্ধন। গোটা বই জুড়েই তিনি বহু উদাহরণ পেশ করেছেন— বাংলা ভাষায় অর্থনীতি (বা সমাজ, রাজনীতি) বিষয়ক প্রবন্ধকে কী ভাবে সুখপাঠ্য করে তোলা যায়, তার উদাহরণ।
আলোচ্য বইটি প্রণববাবুর বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধ, বক্তৃতা, এবং সাক্ষাৎকার ইত্যাদির সঙ্কলন। লেখাগুলি চারটি ভাগে বিভক্ত— রম্যরচনা; ভারতীয় সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি; পশ্চিমবঙ্গের হাল; এবং বামপন্থার ভূতভবিষ্যৎ। সেই ভাগ ধরেও লেখাগুলি পড়া সম্ভব; আবার, প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে বিভিন্ন মাপের লেখায় কী ভাবে এক উদার, বহুত্ববাদী ভারতীয়ের নিজস্ব বিশ্বাসগুলি বেরিয়ে এসেছে, নিবিড় পাঠে সেই সন্ধানও মিলতে পারে।
১৯৮৬ সালে লেখা ‘দাসদাসী ও আমরা’ শীর্ষক লেখাটিতে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, তথাকথিত উদার পরিবারের পরিসরে গৃহ পরিচারক বা পরিচারিকাদের প্রতি অসহ বৈষম্য কী ভাবে সম্পূর্ণ ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠেছে, সে কথা লিখতে লিখতেই প্রণববাবু অবতারণা করেন একটি গল্পের। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সদ্য চিনফেরত এক অধ্যাপককে পার্টি অফিসে নিমন্ত্রণ করে তাঁর কাছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মোদ্দা কথাটা জানতে চেয়েছিলেন এক জাঁদরেল বামপন্থী নেতা। অধ্যাপক বলেছিলেন, “আপনাদের দলের অফিসের চাকরটি, যে খানিকক্ষণ আগে আমাদের চা দিয়ে গেল, এখন বাইরে বসে অপেক্ষা করছে, কখন বাবুদের মিটিং ভাঙবে, তারপর তালা দিয়ে বাড়ি যাবে সে, মাও চাইছেন যে আপনারা তাকেও এই আলোচনার মধ্যে ডেকে আনুন, এমন বিষয়ে আলোচনা করুন, যাতে সেও সমান অংশগ্রহণ করতে পারে।” ভারতীয় বামপন্থীদের ব্যর্থতা বিষয়ে ২০১৩ সালের অন্য একটি লেখায় প্রণববাবুর মন্তব্য, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিককে তাঁরা সংগঠিতই করতে পারেননি— “সচরাচর ভারতের বামপন্থী ভাবনা শ্রমিক আন্দোলনের ভিতরকার (বিশেষ করে সংগঠিত আর অসংগঠিত শ্রমিকদের) দ্বন্দ্বগুলোকে এবং অসংগঠিতদের বিশেষ ধরনের জরুরি সাংগঠনিক প্রয়োজনগুলোকে ধামাচাপা দিয়েই চলে।”