Advertisement
১০ জুন ২০২৪
পুস্তক ১...

একটি নীরব আত্মমগ্ন চর্চার পট

রবীন্দ্রসৃষ্টির অলংকরণ, অভীককুমার দে। প্রতিক্ষণ, ২০০০.০০। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়রবীন্দ্রসৃষ্টির অলংকরণ, অভীককুমার দে। প্রতিক্ষণ, ২০০০.০০। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

প্রতিক্ষণই মনে হচ্ছে ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত রবীন্দ্রসৃষ্টির অলংকরণ গ্রন্থটি বার বার উল্টেপাল্টে দেখি। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, আমি চলচ্চিত্র দেখছি। একটি সময় থেকে ধীরে ধীরে আরও একটি সময়ের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি। সাহিত্যের চিত্ররূপের ক্ষেত্রে এ এক উত্তরণের আলো।

গ্রন্থের প্রথম দিককার পটগুলি দেখলেই তারা বলে দেয় তারা কেমনটি। আর বোঝা যায়, বাণিজ্যিক শিল্পে আমাদের জানাশোনার ক্ষীণ দিকটির কথা। রবীন্দ্রনাথের সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রথম দিকের যে পট, তা যেন কেবলই ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত। সাহিত্যের অন্তর অনুভবের সঙ্গে কোথাও তার মেলবন্ধন ঘটেনি। এই না ঘটার দিকটি রবীন্দ্রনাথের কাছেও স্পষ্ট ছিল। আর এই অনুভবকে উত্তরণের আলোয় নিয়ে যেতে কবি স্বয়ং কলমের মতোই তুলি ধরেছিলেন। যেখানেই তিনি তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির সঙ্গে নিজে অলংকরণ গড়েছেন সেখানে পাঠ ও পট একাসনে। দু’টির মাঝে আলাদা করে কান পাতলে একই সুরের অনুরণন। এ তো রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অলংকরণের আর এক বিশেষ মাত্রা।

গ্রন্থটিতে পর্যায়ক্রমে পটগুলির স্থাপনার গুণে একটি অগ্রসরের দিক দেখতে পাওয়া যায়। এক এক সময় মনে হয় কোনটি আগে? আগে পট, তার পর তাকেই আধার করে সাহিত্য। প্রথমে চিত্রভাষা তার পর অক্ষর ভাষায় বিকশিত! কিন্তু সমগ্র গ্রন্থটির পথে হাঁটতে থাকলে বেশ বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজে চিত্রায়িত করার সঙ্গে সঙ্গে আর জনের একান্ত অপেক্ষা করছেন। প্রথম দিকের চিত্রপটগুলি দেখলে বেশ বুঝতে পারি, কবির এ বিষয়ে করার কিছু ছিল না। তাঁর হৃদয়ে যে স্তরের অলংকরণের প্রাণছন্দ খেলে বেড়াত, তার রূপকারের একান্ত অপ্রতুলতা শুধু নয়, তা ছিলই না। বেশ কিছু দিনের ব্যবধানে তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে চিত্রশিল্পীরা একেবারে আলাদা করে এক সৃষ্টির আরম্ভ করলেন। রবীন্দ্রসৃষ্টির

‘একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুঁদি গড়।’ চয়নিকা, শিল্পী নন্দলাল বসু

অলংকরণের পথ ধরে আমাদের সংস্কৃতি জগতে অলংকরণ রচনার একটি বিশেষ ঘরানা গড়ে উঠেছে আর এই ঘরানার আঙ্গিক প্রকাশটি একেবারে দূষণমুক্ত হিসেবে উজ্জ্বল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রন্থটিতে লক্ষ করলে এই নিজস্ব ঘরানা গড়ে ওঠার ধারাবাহিকতাকে ধরা যায়। প্রথম দিকের অলংকরণে আমাদের এক বিশেষ অনুকরণের দাসত্ব ছিল। বাণিজ্যশিল্পকলার পথে আমাদের নিজস্ব কোনও আঙ্গিকই তখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। কিন্তু নিজের সৃষ্টিকে আশ্রয় করে যে চিত্রণকে কবি চেয়েছিলেন তা সেই চাওয়ার পূর্ণতায় পূর্ণ হয়েছে। তাঁর সৃষ্টির অলংকরণের এই গ্রন্থ আমাদের শব্দকোষের মতো কাজ করেছে। আর রবীন্দ্ররচনার আরম্ভের সময় থেকে আজও এই অলংকরণের একটি বহমানতার ছাঁদ প্রবহমান। এই অলংকরণের ভাবনায় একটি স্বতন্ত্র যে ঘরানার দিক সেটি পরিপূর্ণতা পেয়েছে। তিনি নিজে এর অভাব অনুভব করতেন আর নন্দলালকে পেয়ে তাঁর সেই ইচ্ছাপূরণের পূর্ণতার দিগন্তকে অনুভব করলেন। নন্দলালকে পাওয়া নিয়ে এই গ্রন্থে সুন্দর আলাপচারিতার স্বাক্ষর রয়েছে যেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে নন্দলাল প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটিকে নিবিষ্ট মনে দেখতে থাকলে দেখব রবীন্দ্রসৃষ্টির যে স্বতন্ত্রতা তার সঙ্গে নন্দলালের যুক্ত হওয়ার কারণে তার অলংকরণেও এক আলাদা স্বতন্ত্রতার উদ্ভাসন। রচনার সঙ্গে পটের এক অসামান্য সাযুজ্যতা। গ্রন্থটির প্রতি পৃষ্ঠায় বিবিধ চিত্রাবলির মাঝে নন্দলাল ছিলেন বিশেষ। এই বিশেষ প্রাপ্তিই রবীন্দ্ররচনার অলংকরণে এক বিশেষ আঙ্গিকের উদ্ভাসন। প্রতিটি অলংকরণে চিত্র সব সময় যেমন রচনার সঙ্গী তেমন নিজস্বতার নিরিখে এক বিশেষ নবভাবনা, নবসৃষ্টি। অথচ লক্ষ করলে দেখি কোথাও কোনও ভিন্ন ঘরানার ছায়া প্রবেশ করেনি। লক্ষ করলে দেখবেন নন্দলাল কৃত অলংকরণে রবীন্দ্রসৃষ্টির সঙ্গে এক বিস্ময়কর সম্পর্ক। শান্তিনিকেতনে থাকাকালীনই নন্দলাল বিশেষ ভাবে এই বিকাশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আর তাঁর পটগুলির আহরণ সুধা সংগৃহীত হয়েছে আশ্রমেরই নিত্য দিনের দেখা উৎসব প্রকৃতির অরূপতায়। অলংকরণের ক্ষেত্রে এটি বেশ বোঝা যায়। এমনও আছে যার সঙ্গে সৃষ্টির রচনার সম্পর্ক নেই তবু সে শোভন। বিশেষ বিশেষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নন্দলালের চিত্রাবলির দিকে দৃষ্টি দিলে বেশ বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের এই সৃষ্টির অঙ্গনে নন্দলালের আর এক ভিন্ন আঙ্গিকের উন্মোচন। বিশেষ করে ‘নটীর পূজা’র বিষয় অবলম্বনে অলংকরণগুলিতেই তা স্বপ্রকাশ। এখানে নন্দলাল কবির এক বিশেষ রুচির দিকটি তাঁর আন্তর অনুভবের মধ্য দিয়ে প্রকাশে সার্থক।

এই সমগ্র গ্রন্থটি শুধু সাধারণ পাঠকই নয় সর্ব স্তরের মানুষের কাছে একটি বিরল দিক তুলে ধরবে। আমাদের আজও সাহিত্যের অলংকরণ হিসেবে কোনও পথই গড়ে ওঠেনি। দেখবেন বইয়ের পটের অর্থ তার প্রতিপাদ্য বিষয় ধরে কিছু পট গড়ে তার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া। এই যুক্তকরণটি সব সময় ছাড়া ছাড়াই থেকে গেছে। রবীন্দ্রসৃষ্টির মাঝ দিয়ে অমন অলংকরণের পর্যায় থেকে এক ভিন্ন মাত্রায় অলংকরণ কেবলমাত্র রচনার সঙ্গী হিসেবে থেকে যায়নি। সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে পট তার নিজস্বতার পথ গড়েছে। বাণিজ্য শিল্পের কাঠিন্য থেকে কেবলই পুস্তকের অলংকরণ আভরণ থেকে ললিতকলা সৃষ্টির পথে এক নব উত্তরণ। প্রথম দিকের পটগুলি দেখলে বোঝা যায় তারা পঞ্জিকা নির্ভর আশ্রয়েই লালিত। এই আশ্রয় ছেড়ে ওই সব পট ক্রমশ ললিতকলার সুকুমার পথে অগ্রসর হল। বর্তমান গ্রন্থটির মস্ত প্রাপ্তি, কোথাও সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি। ধীরে ধীরে নিশ্চিন্তে একটি বিশেষ ভাবনার অগ্রসরতাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব হল।

অনেকগুলি অধ্যায়ের এই গ্রন্থের আরও বড় আকর্ষণ প্রতিকৃতি অংশে। প্রত্যেকটি প্রতিকৃতির মাঝে কেবলই মুখমণ্ডল নয় তার সঙ্গে তার অনুভবের আশ্চর্য বিভার সঙ্গ। চরিত্রানুযায়ী প্রতিকৃতিগুলি সব সময় এক বিশেষ মাত্রায় বিরাজ করছে। এই অলংকরণের মধ্য দিয়ে আর এক কবিকে নিশ্চিত ভাবে পেয়েছি। তাঁর সাহিত্য রচনার সঙ্গে তাকে পটের রেখায় সাজিয়ে তোলা এক বিশেষ অলংকরণের কারুকাজও দেখার। যেখানে আরও ভিন্ন অলংকরণের ছন্দেরা দাঁড়িয়ে, সেখানে আলোছায়ার একটি বিশেষ মাত্রায় লুকোচুরির ছন্দটি একেবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। এটি অলংকরণ বিষয়ের হলেও শিল্প চর্চার একটি বিশেষ প্রকাশের পথ দর্শায়। বেশ বোঝা যায় শিল্পকলার করণকৌশলের প্রয়োগের একটি বিশেষ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সচলতার প্রাণছন্দটি সব সময় সজীব।

অনেক ক্ষেত্রে নিজের কৃত পট নিয়ে নিজেই কৌতুক করেছেন। এই কৌতুক করার সঙ্গে পটের মেলামেশার আবেশ বর্তমান। পূর্ণ পট কিংবা অলংকরণের নকশা গড়ার কাজে একটি বিশেষ আনন্দবোধ করতেন। ছবি গড়া বা যে কোনও শিল্পকর্মের মাঝে কোথাও কোনও অবহেলার ছোঁয়া নেই। স্বচ্ছন্দ অনুভবের এই কাজগুলি দেখলে বোঝা যায় চিত্র রচনার মধ্যে কবি কতটা ভাল লাগায় বসবাস করতেন। আমাদের আলোচ্য এই গবেষণাগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের রেখার বিচিত্র গতিধর্মের একটি দিক দেখতে মস্ত সহায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আবরণে এমন রেখাদের পাওয়া সম্ভব নয়। নজর দিলে বুঝতে পারব এই রেখারা এক নিজস্ব ছন্দসুধায় পরিপূর্ণ। আমার নিজের এক এক সময় মনে হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাঝ দিয়ে এলে আমরা এমন রবীন্দ্রনাথ পেতুম না। এই গ্রন্থ নিশ্চিত ভাবে একটি সুচারু পথরেখা গড়ে দিতে সাহায্য করেছে।

গ্রন্থের সৌষ্ঠবটি সার্বিক রুচির নিদর্শন। সংগ্রাহক যেমন পরিশ্রমে কাজটি করেছেন তেমনই সুন্দর ভাবে তাকে প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রকাশকের সাধুবাদ অবশ্যই প্রাপ্য। তবে রবীন্দ্রসৃষ্টির অলংকরণের পথে অবশ্যই আরও চর্চা ও অনুসন্ধানের দিক থাকবে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য স্বত্ব উঠে যাওয়ার পর এই সাহিত্যসৃষ্টিকে কেন্দ্র করে আরও অনেক বিচিত্র অলংকরণের দিক গড়ে উঠেছে যেগুলি সব সময় সুসংহত সুন্দর হয়ে উঠতে পারেনি। এই সৃষ্টির নানান অলংকরণও স্থান পেয়েছে যা সব সময় নয়ন ও রুচি সুখকর হয়ে ওঠেনি তবে এই গ্রন্থ নিঃসন্দেহে এই চর্চা পথের একটি বিশেষ দিকদর্শন। গ্রন্থটি আগামী কালে ওই বিষয়ে অগ্রসর হওয়ার বিশেষ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। লেখায় রেখায় মিলে সুনিপুণ গ্রন্থটি কেবলই উচ্ছ্বাস নয়, একটি নীরব আত্মমগ্ন চর্চারও পট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE