Advertisement
১০ জুন ২০২৪
পুস্তক ২...

বিবিধ বিন্যাসে আর কত রবীন্দ্র-রচনাবলি

কালানুক্রমিক রবীন্দ্র-রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, কার্যনির্বাহী সম্পাদক: গৌতম ভট্টাচার্য। বিশ্বভারতী, ১০০০.০০ রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তম ও অষ্টম খণ্ড, সম্পাদকমণ্ডলীর সভানেত্রী: শাঁওলী মিত্র। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রতিটি ৬০০.০০কালানুক্রমিক রবীন্দ্র-রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, কার্যনির্বাহী সম্পাদক: গৌতম ভট্টাচার্য। বিশ্বভারতী, ১০০০.০০ রবীন্দ্র-রচনাবলী, সপ্তম ও অষ্টম খণ্ড, সম্পাদকমণ্ডলীর সভানেত্রী: শাঁওলী মিত্র। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, প্রতিটি ৬০০.০০

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৪ ২১:৫২
Share: Save:

বন্ধুরা আমার এত কালের অধ্যবসায়কে যে নিশ্চিত শ্রদ্ধার মূল্য দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন আমিও তাকে শ্রদ্ধা করে সেই দানের মধ্যে আমার শেষ পুরস্কার গ্রহণ করব। কাল তাঁদের ফাঁকি দেবে না এবং বিড়ম্বনা করবে না কবিকেও, এই কথায় সংশয় করার চেয়ে বিশ্বাস করাতে উপস্থিত লাভ, কেন না কালের দরবারে এর শেষ মীমাংসার সম্ভাবনা দূরে আছে।’’

বিশ্বভারতী-র প্রথম রবীন্দ্র-রচনাবলির প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় এ কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিজের রচনাবলিতে কোনও দিনই নিজের অপরিণত রচনাকে স্থান দিতে চাননি তিনি। কিন্তু পরে ইতিহাসের খাতিরে মেনেও নিয়েছেন বন্ধুজনের কথা।

সেই ইতিহাসের খাতিরেই কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের সহায়তায় বিশ্বভারতী সম্প্রতি প্রকাশ করল কালানুক্রমিক রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার এই খণ্ডে ধরা আছে ১২৮০-১২৮৭ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনা। অর্থাৎ সাত বছরের ফসল। সহজেই অনুমেয়, এ রচনাবলির খণ্ডসংখ্যা কত দূর যাবে।

এমন একটি কালানুক্রমিক রচনাবলি-র প্রথম চার খণ্ড বেশ কিছু কাল আগে প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বভারতী থেকেই। কিন্তু সেই প্রকল্পেরই এই নবরূপ অনেক বেশি পরিণত এবং বাস্তববাদী। কঠোর ভাবে কালানুক্রম মানতে গিয়ে সেখানে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত একই রচনার বিভিন্ন কিস্তির মাঝেও ঢুকে গিয়েছিল অন্য রচনা। সেই নিতান্ত অব্যবহার্য বিন্যাস এ বার বর্জিত হয়েছে। ধারাবাহিক রচনার সব কিস্তি পরপর রেখে মধ্যবর্তী কালে প্রকাশিত রচনাগুলির নাম কেবল পাদটীকায় তারকাচিহ্ন দিয়ে উল্লেখিত হয়েছে। যে কোনও সজীব, গতিশীল লেখকের রচনার ক্ষেত্রেই কালানুক্রম নামক একটি নিছক যান্ত্রিক বিন্যাসকে সর্বতো ভাবে মান্য করা সম্ভব হয় না। সেই বাস্তবতাকে এই নতুন রচনাবলি স্বীকার করে নিয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ ও রচনা প্রথম প্রকাশের কালানুক্রমে সাজানো হয়েছে। অপ্রকাশিত রচনার ক্ষেত্রে ধরা হয়েছে রচনাকাল। কিন্তু আবার, যে ক্ষেত্রে পত্রিকার পাঠ বইয়ে বদলে গিয়েছে সে ক্ষেত্রে বদলের পরিমাণ ও প্রকৃতি বিচার্য হয়েছে। অর্থাৎ ‘উল্লেখযোগ্য’ পরিবর্তন না থাকলে পত্রিকার গ্রন্থপাঠ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সিদ্ধান্তটি বাস্তববাদী, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে উল্লেখযোগ্যতার বিচার কি সত্যই ব্যক্তি-নিরপেক্ষ হতে পারে?

পরবর্তী খণ্ডগুলির ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় নীতি নিশ্চয় আরও পুনর্বিবেচিত হবে। আলোচনায় বেরিয়ে আসবে নতুন পথ। কিন্তু আপাতত এই খণ্ডটির বিন্যাস এবং পরিকল্পনা রবীন্দ্ররচনার ঐতিহাসিক বিবর্তনটিকে ধরে রাখাতেই সার্থকতা পাবে বলে মনে হয়। ইতিহাস-বিস্মৃত বলে বাঙালির বদনাম আছে। অন্তত রবীন্দ্ররচনার প্রকাশের ক্ষেত্রে সে অপবাদ আর দেওয়া যাবে না। এই খণ্ডের পুরোবাক্-এ বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত রবীন্দ্ররচনাকে ‘সময়ের তীর’ বা দি অ্যারো অব টাইম-এর পাশাপাশি রেখে সুচিন্তিত বিশ্লেষণ করাই এই রচনাবলির উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন। সে কাজের অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিভূমি এই রচনাবলি।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র-রচনাবলী-র সম্প্রতি প্রকাশিত সপ্তম ও অষ্টম খণ্ড পূর্ববর্তী খণ্ডগুলির মতোই সংরূপানুক্রমে সাজানো। সপ্তম খণ্ডের সংরূপ গান। এই খণ্ডে প্রচলন থেকে বেশ কিছুটা সরে গিয়েছে সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত। প্রচলিত গীতবিতান-এর কবিকৃত উপপর্যায়গুলি ফিরিয়ে আনা হয়েছে এখানে, অন্তর্ভুক্ত হয়েছে গীতবিতান-বহির্ভূত গান এবং গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্যগুচ্ছ। তার ফলে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র গানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খণ্ড হতে পেরেছে এটি। এই সূত্রেই সম্পাদকীয় নিবেদনে জানানো হয়েছে, সমগ্র গানের পাঠান্তর নির্ণয়ের কাজেও ব্রতী হয়েছেন এই রচনাবলির সম্পাদকমণ্ডলী, গ্রন্থপরিচয় খণ্ডে তার আরও বিস্তৃত পরিচয় থাকবে। সাধু উদ্যোগ, সন্দেহ নেই।

এই রচনাবলির অষ্টম খণ্ডে আছে উপন্যাস। ‘করুণা’ থেকে ‘নৌকাডুবি’ পর্যন্ত। অর্থাৎ করুণা, বউ-ঠাকুরানীর হাট, প্রজাপতির নির্বন্ধ, রাজর্ষি, চোখের বালি এবং নৌকাডুবি। ‘করুণা’ বিশ্বভারতীর রচনাবলিতে গল্পগুচ্ছের অন্তর্গত। তাকে উপন্যাস হিসেবে ধরাও যায়। কিন্তু সেটা করলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘বন-ফুল’ তা হলে উপন্যাস হিসেবে এই খণ্ডে নয় কেন? স্পষ্টত ও বইয়ের উপ-শিরোনামে লেখা ছিল ‘কাব্যোপন্যাস’। তা ছাড়া পদ্য আর গদ্য তো ভাষারূপ, সাহিত্যের সংরূপের সঙ্গে তার বিরোধ তো নেই কোনও। কবিতা যেমন গদ্যে লেখা যেতে পারে, উপন্যাস, এমনকী ছোটগল্পও তো লেখা যেতে পারে পদ্যে।

আসলে রবীন্দ্ররচনাকে সংরূপায়িত করার এই বিপদটাই অধুনা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আমরা আজও কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি যে এ রবীন্দ্ররচনাবলি লইয়া কী করিব? তাই বিবিধ অনুক্রমে আজও বহমান রবীন্দ্ররচনাবলি প্রকাশের ধারা। শেষ মীমাংসার সম্ভাবনা এখনও দূরেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE