কলেজের এই ভিড় উচ্চশিক্ষার স্বাস্থ্যের একমাত্র সূচক বলে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। নিজস্ব চিত্র
রবীন্দ্রনাথের যে কোনও একটা গানের প্রথম পঙ্ক্তি বলতে পার? প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ে বাংলা অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ঘরে পিন পড়লেও শোনা যাবে, এমন নিস্তব্ধতা। মিনিটের পরে মিনিট গড়িয়ে যায়। শেষে উত্তর আসে, —‘দোষ কারও নয় গো মা’। প্রশ্ন করি, ‘কে বলল তোমায়, এটা রবীন্দ্রনাথের গান?’ উত্তর আসে, ‘জানি, আমাদের এলাকার সাংসদ গেয়েছেন’।
কেউ বিক্ষিপ্ত উদাহরণ বলতে পারেন, কিন্তু এই উত্তর আসানসোল এলাকার শিক্ষা ব্যবস্থার খুব উজ্জ্বল ছবি আঁকে, বলা যাচ্ছে না। এটা খণ্ড চিত্র হলে খুশি হতেন অনেকেই। কিন্তু সমস্যার শিকড় যে অনেক গভীরে পৌঁছেছে তা বোঝা যায় পরবর্তী প্রশ্নোত্তরে। অনেক ছাত্রছাত্রী আছেন যাঁরা মাতৃভাষা বাংলার বর্ণমালার ‘ক’ থেকে ‘য়’ পর্যন্ত নির্ভুল ভাবে বলতে পারবে না। বলতে বলতে আটকে যায়। মুখে ফুটে ওঠে অসহায় হাসি। বলতে পারেন না বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বা নাটক কোনটি। অথবা জাতীয় সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ ‘পাঞ্জাব’ বানান কী লিখেছেন। অতি সাধারণ প্রশ্ন। অথচ, যাঁদের বুকে এ প্রশ্ন বজ্রকঠিন হয়ে আটকে থাকে, তাঁরাই বছরের পরে বছর অনার্স, এমএ, বিএড পাশ করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টা হাড়ে হাড়ে বোঝেন। এ-ও বোঝেন ছাত্রছাত্রীরা যদি মূল পাঠ্যবই বিশদে না পড়েন, তা হলে জ্ঞানের বা জানার অগভীরতা থেকে যাবেই। পড়ুয়াদের পাঠ্যবই পড়তে বাধ্য করতে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষায় ছোট ছোট প্রশ্ন আমদানি করা হয়েছে। উদ্যোগ সাধু। কিন্তু গতিক বুঝে বাজারে বেরিয়ে গেল ছোট প্রশ্নের বই। পড়ুয়ারা গলগল করে তা-ই মুখস্থ করেন। ফলে, মূল পাঠ্যবই তোলা থাকল কুলুঙ্গিতে। ভাষা-জ্ঞান ভাসাভাসা হয়ে থাকল। এই সব কারণে ‘দোষ কারও নয় গো মা’ হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের গান। আপাতত এই উলটপুরাণ থামার কোনও লক্ষণ নেই। এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।
বর্ধমান পশ্চিমে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটছে না। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। তাই দূরশিক্ষার এখন অধিক প্রচলন। ঘরে ঘরে পড়ার নামে ‘নোট’-এর আরাধনা। গজিয়ে উঠেছে নোট-বাজার, নোট-অ্যাকাডেমি। পড়ুয়াদের তাতেই আগ্রহ। সেই সঙ্গে সর্বদুশ্চিন্তাহরা টিউশন-প্রথা। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ ঝোপ বুঝে কোপ মারছেন। এমন সময় পশ্চিম বর্ধমানের এক কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির পরিসংখ্যান ভয়ের কারণ। সাম্মানিক ও সাধারণ বিএ, বিএসসি, বিকম-এ ওই কলেজে মোট আসন ১৫৯৩। অথচ পড়ুয়া ভর্তি হয়েছেন ২৪৫ ।
উচ্চশিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের এই অনাগ্রহ কেন? কারণ, খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা পদ্ধতি যদি নোট বা টিউশন নির্ভর হয়, তা হলে এ ধরনের বিপদ অস্বাভাবিক নয়। তাইস্বামী বিবেকানন্দের বিষয়ে মাত্র পাঁচটি লাইন বলতে বললে কলেজ পড়ুয়াদের শ্রেণিকক্ষ নিথর হয়ে যায়।
না হয় উচ্চশিক্ষার এই হাল, স্কুল স্তরে কেমন পঠনপাঠন হচ্ছে, তা-ও খবর নেওয়া যেতে পারে। মূলত স্কুলছুট পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করতেই মিড-ডে মিল প্রকল্প চালু হয়েছে। তাতে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা ক্ষুধার হাত থেকে বেঁচেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকল্প চালাতে গিয়ে শিক্ষকেরা হিমসিম। বাচ্চাদের জন্য দুপুরে ডাল-ভাত-তরকারির বন্দোবস্ত করতে গিয়ে অনেক জায়গাতেই মার খাচ্ছে পঠনপাঠন। বহু স্কুলে যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক না থাকাটা সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
বর্ধমান পশ্চিমে দুর্গাপুর বা আসানসোলের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সম্পন্ন পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল এবং প্রাইভেট টিউশনের সহায়তায় বিদ্যাবোঝাই হতে পারছে সহজে। কিন্তু এ সব শিল্প-শহরের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে যে অজস্র গ্রাম-গঞ্জ, সেখানে শিক্ষা এখনও অপ্রতুল। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া নার্সারি স্কুলের রমরমা কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল স্বাস্থ্যের ছবি তুলে ধরে না।
আসানসোল, দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, চিত্তরঞ্জন, কুলটির মতো শহরগুলির মানচিত্র থেকে চিরকালের জন্য মুছে গিয়েছে অনেক বড় শিল্প কারখানা। সেই সব কারখানার নিজস্ব জমিতে এখন ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আপাত ভবিষ্যতহীন স্কুল-বাড়ি। এই সব স্কুলে কর্মীদের ছেলেমেয়েরা ছাড়াও পড়ত পাশের গ্রাম-গঞ্জের পড়ুয়ারা। তাদের সামনে এখন নিরন্ধ্র অন্ধকার। রাজ্য সরকারি স্কুল নয় বলে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা এদের নেই। স্থানীয় কবি বিজন রায় তাই আক্ষেপ করে লেখেন,—‘একটা কারখানা শুকিয়ে গেলে মাইল মাইল অশ্রু জেগে থাকে’। শিল্পাঞ্চল জুড়ে অশ্রুর এমন অবিরাম বর্ষণ চলছেই।
অথচ, এমন হওয়ার কথা ছিল না। মূলত কয়লার টানেই এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে জনপদ। প্রথমে রানিগঞ্জ, পরে আসানসোল। এখানে জনপদ জমে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মিশনারিরা একে একে গড়ে তোলেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল— সেন্ট ভিনসেন্ট (১৮৭৭), লোরেটো কনভেন্ট (১৮৭৭) এবং সেন্ট প্যাট্রিক (১৮৯১)। ১৯০৪–এ ঊষাগ্রাম প্রাইমারি স্কুলও মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত। তখনও শিল্পাঞ্চলে এখনকার মতো জন-বিস্ফোরণ ঘটেনি। পরে জনপদ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। একাধিক কলেজ, এমনকী, সম্প্রতি আসানসোলে কবি নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। তবে তার পরেও এই অ়ঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশ ভাল পড়াশোনার আশায় পাড়ি দিচ্ছেন দক্ষিণ ভারতে। সে জন্যই স্থানীয় কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট আসন ফাঁকা থাকার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়।
লেখক: চিত্তরঞ্জন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy