প্রতীকী ছবি।
২০০১ সাল পর্যন্ত সংখ্যাটা ছিল মাত্র এক। সতেরো বছরের তা দেড়শো ছাড়িয়েছে। সংখ্যাটা, দেহদানের অঙ্গীকারের। কিন্তু এই ‘সাফল্য’-এর পরেও দেহদানের ক্ষেত্রে দুর্গাপুরবাসী যাতে আরও এগিয়ে আসেন, তার জন্য আর্জি জানাচ্ছেন এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত লোকজন।
বিভিন্ন সংগঠন সূত্রে জানা যায়, দুর্গাপুরে প্রথম দেহদান করেছিলেন শ্রমিক নেতা রঞ্জিত চক্রবর্তী। তবে তা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উদ্যোগে। দুর্গাপুরে দেহদানে সচেতনতা তৈরির আন্দোলনের শুরু হয় ২০০১-এ। প্রথম দিকে নানা ধরনের কুসংস্কার, সরকারি দফতরের বিরুদ্ধে অনীহার অভিযোগ, পরিকাঠামোর অভাব-সহ নানা অন্তরায় ছিল বলে জানা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ২০০১-র সেপ্টেম্বরে দেহদানের উপযোগিতা বিষয়ে আলোচনাসভা আয়োজন করে ‘যুক্তিবাদী সমিতি’। তাতে বক্তব্য রেখেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা চিত্তরঞ্জন মাইতি, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বিজয় মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। কলকাতার ‘গণদর্পণ’-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকারপত্র চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেকেই অঙ্গীকার করেন। ২০০২-র ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যু হয় দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের প্রাক্তন কর্মী গোপালশঙ্কর দত্তের। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে তাঁর দেহদান করা হয়। দুর্গাপুরের দ্বিতীয় ও তখনও পর্যন্ত সাবেক বর্ধমানে ১১তম দেহদান ছিল সেটি। সম্প্রতি বর্ধমান মেডিক্যালের পাশাপাশি দুর্গাপুরের শোভাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালেও দেহদানের ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
কিন্তু দেহদানের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? চিকিৎসকেরা জানান, ‘প্যাথোলজিক্যাল পোস্ট-মর্টেমে’র মাধ্যমে যে কোনও সাধারণ মৃত্যুরও প্রকৃত কারণ জানা যায়। চিকিৎসকেরা অনেক সময় যে কারণে মৃত্যু বলে জানান, ময়না-তদন্তের পরে অন্য কোনও কারণ বেরিয়ে আসে। এর ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন দিক খুলে যায়। মৃতের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অনেকের জীবন বাঁচে। শব ব্যবচ্ছেদের সুযোগ পান মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারাও। বেঁচে থাকাকালীন এক জন দু’টি কিডনির একটি, লিভারের অংশবিশেষ, এমনকি প্রয়োজনে কর্নিয়াও দান করা যায়। কিন্তু ‘ব্রেন ডেথ’ হলে বা মরণোত্তর দেহদানে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তো বটেই, এমনকি ত্বকও কাজে লাগানো যেতে পারে। কোনও বিশেষ কারণে শরীরের অঙ্গগুলি নষ্ট হয়ে গেলে হাড় ও কঙ্কালও চিকিৎসাবিজ্ঞানের পঠন-পাঠনে কাজে আসে।
বছর সাতেক ধরে দুর্গাপুরে দেহদান নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালাচ্ছে ‘মুক্তচিন্তা’ নামে এক সংগঠন। সংগঠনের সম্পাদক সৌরভ দত্ত আগে যুক্তিবাদী সমিতির দুর্গাপুর শাখার সম্পাদকও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মরদেহ নিয়ে নানা কুসংস্কার রয়েছে। সেগুলির বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচার জরুরি। আমরা আমাদের মতো করে আইন ও বিজ্ঞানের পথ ধরে কাজ করে চলেছি।’’ তিনি জানান, প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গী়কার করতে পারেন। নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করতে হয়। তা পাঠানো হয় ‘গণদর্পণে’। সেখান থেকে তা রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। একটি ফর্ম জমা থাকে সংগঠনের কার্যালয়ে। তৃতীয়টি তুলে দেওয়া হয় পরিবারের হাতে। সৌরভবাবু বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত দুর্গাপুর থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ১২০টি দেহ দুর্গাপুর থেকে গিয়েছে। ৩০টিরও বেশি দেহ গিয়েছে শোভাপুরের বেসরকারি হাসপাতালেও। দেশের অন্যত্র এই হার তুলনায় বেশি। আমরা পিছনের সারিতে আছি। তাই আমাদের আরও তৎপর হতে হবে।’’
চলতি বছরের জুন থেকে ‘দুর্গাপুর ব্লাইন্ড রিলিফ সোসাইটি’র তরফেও মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে শহরে। অঙ্গীকারপত্রে প্রথম সইটি করেন দুর্গাপুরের তৎকালীন মহকুমাশাসক শঙ্খ সাঁতরা। এখনও পর্যন্ত তিনি ছাড়া আরও তিন জন অঙ্গীকার করেছেন বলে জানিয়েছেন সংস্থার সম্পাদক কাজল রায়। তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই এগিয়ে আসছেন। তবে তা যথেষ্ট নয়। সচেতনতা গড়ার কাজে আরও জোর দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy