Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Serampore

সংসারের সুরাহায় ‘লক্ষ্মীর ঘট’ ভাঙলেন বাস শ্রমিকরা

সিঙ্গুরের হাকিমপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ আদক ১৯৭৬ সালে হেল্পার হিসেবে ওই রুটে কাজে ঢোকেন। পরে কন্ডাক্টর হন। তার পরে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাস চালিয়েছেন। এখন স্কুলের গাড়ি চালান। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল যখন তৈরি হয়, তখন তিনি শ্রমিক-সংগঠনের সম্পাদক।

চেক হাতে দুই শ্রমিক। —নিজস্ব িচত্র

চেক হাতে দুই শ্রমিক। —নিজস্ব িচত্র

প্রকাশ পাল
শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৩:০৪
Share: Save:

দুঃসময় এলে লক্ষ্মীর ঘট ভেঙে শেষ সম্বলটুকু আঁকড়ে বাঁচা গ্রামবাংলায় অভাবের সংসারে প্রাচীন রীতি। অনেকটা তেমনই কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ ভাগ করে দেওয়া হল শ্রীরামপুর-কাঁড়ারিয়া ১২ নম্বর রুটের বাসের শ্রমিকদের মধ্যে।ওই রুটের বাসমালিক সংগঠনের সম্পাদক রাজীব নন্দী বলেন, ‘‘বেআইনি টোটো, রুটভাঙা অটোর দৌরাত্মে আমরা তো শেষ হয়েই গিয়েছিলাম। ট্রেন না চ‌লায় পরিবহণ দফতরের কর্তাদের অনুরোধে জুলাই মাস থেকে বাস চলছে। কিন্তু শ্রমিকদের দুর্দশা ঘোচেনি। সামনে পুজো। বলতে পারেন, নানা সমস্যায় জর্জরিত শ্রমিকের সংসারে একটু সুরাহার জন্য লক্ষ্মীর ভাঁড় ভাঙতে হল।’’

বাসমালিক সংগঠন সূত্রের খবর, শ্রীরামপুর থেকে বৈদ্যবাটী হয়ে নসিবপুর, সিঙ্গুর, হরিপাল, তারকেশ্বরের উপর দিয়ে কাঁড়ারিয়া পর্যন্ত এই রুটের বাস চালু হয় ১৯৫৩ সালে। এক সময় এই রুট ভালই লাভজনক ছিল। চল্লিশের বেশি বাস চলত। অভিযোগ, কয়েক বছর আগে থেকে বেআইনি গাড়ির দৌরাত্মে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। যাত্রী কমে যায়। টোটোর আগমনে সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হয়।

টিকিট বিক্রির নিরিখে চালক, কন্ডাক্টর কমিশনের ভিত্তিতে বেতন পান। হেল্পার দৈনিক মজুরি পান। অভিযোগ, কয়েক বছর ধরে দৈনিক দেড় হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হলে শ্রমিকের বেতন, ডিজেল এবং রক্ষণাবেক্ষণ মিলিয়ে খরচ হচ্ছি‌ল তার দ্বিগুন। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা টানতে না পেরে বছর খানেক আগে এই রুট বন্ধই হয়ে যায়। গত জুলাই মাস থেকে টিকে থাকা ১৮টি বাস ফের চলছে। এক বাস মালিক বলে‌ন, ‘‘এখন কিছুটা যাত্রী হচ্ছে। দু’টো পয়সা ঘরে আসছে। কিন্তু আহামরি কিছু নয়।’’

বাসমালিকরা জানান, শ্রমিকদের আপৎকালীন পরিস্থিতি এবং অবসরকালীন সুবিধার কথা ভেবে ১৯৯৮ সালে টাকা জমানো শুরু হয়। বাস-শ্রমিক দৈনিক ৩ টাকা এবং বাসমালিক সমপরিমান টাকা দেন। অর্থাৎ দৈনিক ৬ টাকা ব্যাঙ্কে জমে। কেউ মেয়ের বিয়ে বা চিকিৎসার সময়, কেউ অবসরের পরে জমানো টাকা তুলতেন। শেষ পর্যন্ত অ্যাকাউন্টে ছিল ১০ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা। সেই টাকাই বর্তমান এবং অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় ৯০ জনের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বুধবার শেওড়াফুলিতে বাসমালিক সংগঠনের কার্যালয়ে তাঁদের হাতে চেক তুলে দেওয়া হয়। রাজীব বলেন, ‘‘প্রাপ্য অনুযায়ী ২ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। এই টাকায় ওঁরা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলে, সেটাই অনেক। কেউ হয়তো দেনা শুধবেন।’’

সিঙ্গুরের হাকিমপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ আদক ১৯৭৬ সালে হেল্পার হিসেবে ওই রুটে কাজে ঢোকেন। পরে কন্ডাক্টর হন। তার পরে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাস চালিয়েছেন। এখন স্কুলের গাড়ি চালান। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল যখন তৈরি হয়, তখন তিনি শ্রমিক-সংগঠনের সম্পাদক। এ দিন তিনি ১৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘টাকাটা পেয়ে খুব ভাল লাগছে। সময়ের বিচারে এটা হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু নিজের রক্ত জল করা টাকায় সংসারের কিছুটা সুরাহা তো হবে!’’ ১৫ হাজার টাকার চেক হাতে পেয়ে গত চার দশকের ‘টাইম কিপার’ নীলোৎপল হালদারও সে কথাই বলছেন। তিনি বলেন, ‘‘বাস বন্ধের সময় পুজোআর্চা করে কোনওরকমে সংসার চালিয়েছি। এখন আবার বাস চলছে। কতদিন চলবে জানি না। মাসিক ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা পাই। কল্যাণ তহবিলের টাকাটা সংসারে কাজে লাগবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bus Workers Serampore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE