Advertisement
১১ মে ২০২৪

ধুঁকছে জেলার বহু স্কুলের গ্রন্থাগার

উচ্চমাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেতে হলে এক একটি বিষয়ের জন্য অন্তত দু’জন লেখকের বই পড়তে হবে। শিক্ষক তো বলেই খালাস। এ দিকে ডোমজুড় খসমরা হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির অনেক পড়ুয়ার দু’টি বই কেনা তো দূরের কথা, একটি বই কেনারও সামর্থ্য নেই।

উলুবেড়িয়ার বাণীবন যদুরবেড়িয়া বিদ্যাপীঠের গ্রন্থাগার। ছবি: সুব্রত জানা।

উলুবেড়িয়ার বাণীবন যদুরবেড়িয়া বিদ্যাপীঠের গ্রন্থাগার। ছবি: সুব্রত জানা।

অভিষেক চট্টোপাধ্যায় ও মনিরুল ইসলাম
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৪৬
Share: Save:

উচ্চমাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেতে হলে এক একটি বিষয়ের জন্য অন্তত দু’জন লেখকের বই পড়তে হবে। শিক্ষক তো বলেই খালাস। এ দিকে ডোমজুড় খসমরা হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির অনেক পড়ুয়ার দু’টি বই কেনা তো দূরের কথা, একটি বই কেনারও সামর্থ্য নেই। মুশকিল আসান হতে পারত স্কুলের গ্রন্থাগার। কিন্তু সেটির তাদের চেয়েও দৈন্যদশা। একটি ছোট ক্লাসঘরে ধুলো পড়া গুটিকয় বই রয়েছে। নেই কোনও গ্রন্থাগারিক। অথচ ২০১৫ সালের সরকারি হিসেব অনুযায়ী এটি ব্লকের সেরা স্কুল। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে এই স্কুলের পড়ুয়ারা নজরকাড়া ফলও করে।

এতো উদাহরণ মাত্র। হাওড়া জেলার অনেক স্কুলেই কোনও গ্রন্থাগার নেই। কোথাও আবার খাতায় কলমে গ্রন্থাগার আছে বটে, কিন্তু নেই কোনও গ্রন্থাগারিক। অল বেঙ্গল স্কুল লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের (এবিএসএল) সভাপতি শিবশঙ্কর মাইতি জানান, বর্তমানে রাজ্যে প্রায় পাঁচ হাজার উচ্চমাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। তার মধ্যে অর্ধেক স্কুলেই গ্রন্থাগারিকের পদটি শূন্য। গ্রন্থাগার নেই এমন স্কুলের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শিবশঙ্করবাবুর ক্ষোভ, ‘‘মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে গ্রন্থাগারিকের পদ থাকে না। এমনকী ওই স্কুলগুলিতে গ্রন্থাগার রাখাও বাধ্যতামূলক নয়। অথচ মাধ্যমিকের প্রস্তুতিতে পড়ুয়াদের অনেক বইয়ের দরকার হয়।’’ তাঁর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট দফতরে বার বার জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি।

কী অবস্থায় রয়েছে জেলার অধিকাংশ স্কুল গ্রন্থাগার?

সরেজমিনে দেখতে পৌঁছনো গেল জয়পুরের ঘোড়াবেড়িয়া আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে গ্রন্থাগার বা গ্রন্থাগারিক কিছুই নেই। অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষিকার দান করা একটি আলমারিতে ঠাসা রয়েছে স্কুলের যাবতীয় বই। একই অবস্থা বাগনান আদর্শ হাইস্কুলেরও। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সুলতা মণ্ডলের আক্ষেপ, ‘‘একটি ভাঙাচোরা ঘরে কোনওমতে বই রাখা হয়েছে। শিক্ষিকারা ক্লাস নেবেন, না গ্রন্থাগার সামলাবেন?’’ তিনি জানান, স্কুলের অনেক পড়ুয়ারই সহায়ক বই কেনার সামর্থ্য নেই। গ্রন্থাগারের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে তারা।

ডোমজুড় ব্লকের রাজাপুর দক্ষিণবাড়ি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রভাত কুমার মণ্ডল জানান, তাঁদের স্কুলের গ্রন্থাগারে কয়েক হাজার পাঠ্যবই এবং গল্পের বই রয়েছে। কিন্তু পড়ুয়ারা তার নাগাল পায় না। কেন না স্কুলে নেই কোনও গ্রন্থাগারিক। প্রভাতবাবু জানান, কয়েক জন শিক্ষক নিজেদের ক্লাস সামলে কোনওমতে গ্রন্থাগার চালু রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আমতা পীতাম্বর হাইস্কুলের সমস্যাটি একটু ভিন্ন। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, একটি ভাঙাচোরা ঘরে রাখা আছে প্রায় ৭ হাজার বই। কিন্তু বৃষ্টির জল সেখানে ছাদ-চুঁইয়ে পড়ে। সেই সময় ত্রিপল দিয়ে আলমারিগুলি চাপা দিয়ে কোনও রকমে বইগুলি রক্ষা করা হয়। প্রধান শিক্ষক তপনকুমার দাস জানান, শুধু পাঠ্য বা সহায়ক বই নয়, এই গ্রন্থাগারে রয়েছে বহু দুষ্প্রাপ্য নথি। কিন্তু তা আর কত দিন ধরে রাখা যাবে সে বিষয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান। একই সমস্যায় ভুগছে বাগনান হাইস্কুল, সন্তোষপুর শ্রীগৌরাঙ্গ বিদ্যাপীঠ, মাজু আরএন বসু হাইস্কুল-সহ গ্রামীণ হাওড়ার অনেক স্কুলই।

হাওড়া জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক তাপস বিশ্বাস বলেন, ‘‘জেলায় মোট ৬৬৮টি স্কুলের মধ্যে ৩০৬টি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে লাইব্রেরি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮০টি স্কুলে গ্রন্থাগারিক রয়েছেন। বাকিগুলিতে শূন্য পদ পূরণের জন্য আমরা স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে আবেদন জানিয়েছি। তাঁরা এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন।

গ্রন্থাগার এবং গ্রন্থাগারিক থাকলেও সমস্যায় পড়েছে জেলার বেশ কয়েকটি স্কুল। বাগনান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ভাস্করচন্দ্র আদক জানান, তাঁদের স্কুলে প্রায় ৪ হাজার বই রয়েছে। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, নতুন সিলেবাস অনুযায়ী সহায়ক বই কেনার জন্য মিলছে না সরকারি অনুদান। তিনি জানান, বছর চারেক আগে এককালীন সাত হাজার টাকা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তার পর থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান এগিয়ে গেলেও গ্রন্থাগার থমকে আছে একই জায়গায়।

গ্রন্থাগারিক না থাকায় স্কুলগুলির সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন স্কুল শিক্ষা দফতরের এক কর্তা। তিনি জানান, পাঠ্য এবং অন্য বই মিলিয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫০০টি ও মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৩০০টি বই থাকলে তবেই স্কুলগুলি সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারে। তার পর স্কুলে গ্রন্থাগার তৈরি করার পরিকাঠামো খতিয়ে দেখে অনুদান দেওয়া হয়। ওই কর্তার দাবি, নির্দিষ্ট সময়ে অনুদানের জন্য আবেদন করে না অধিকাংশ স্কুলই।

এই পরিস্থিতিতে জেলার এক শিক্ষাবিদের বক্তব্য, ‘‘শুধু পরীক্ষায় ভাল ফল করার জন্য নয়, শিক্ষার ভিত তৈরি করতে গ্রন্থাগারের দরকার।’’ তাঁর আক্ষেপ, পরীক্ষায় সাফল্যের পিছনে ছুটতে গিয়ে গ্রন্থাগার যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না বর্তমান শিক্ষা পরিস্থিতিতে। তাঁর মতে, এতে আখেরে রাজ্যের শিক্ষার মানেরই ক্ষতি হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE