অস্বাভাবিক: বোনের দেহ আগলে রেখেছেন দাদা নীলমণি ধাড়া। ছবি: সুব্রত জানা
বছর তেষট্টির বৃদ্ধার নিথর দেহ শোয়ানো ছিল মেঝেতে। পরিপাটি করে চাদর পেতে তৈরি বিছানা। খাটে বসে বৃদ্ধার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েছিলেন তাঁর দাদা, বছর সত্তরের নীলমণি ধাড়া। বোন মারা গেলেও তাঁর দেহ সৎকার না করে দিন তিনেক ধরে এ ভাবেই বসেছিলেন তিনি। মৃতদেহে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়ালে পড়শিরা খবর দেন থানায়। শেষ পর্যন্ত বুধবার পুলিশের হস্তক্ষেপে মৃতদেহ সৎকার হওয়ায় হাঁপ ছাড়েন প্রতিবেশীরা। মৃতদেহ সৎকার না করে ফেলে রাখা নিয়ে নীলমণিবাবু জানান, বোনের মৃতদেহ সৎকারের টাকা ছিল না। উলুবেড়িয়ার ময়রাপড়ার এই ঘটনা অনেকেকেই কলকাতার রবিনসন স্ট্রিটের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে। সেখানেও দিদির মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ধরে দেহ রেখে দিয়েছিলেন তাঁর ভাই।
ময়রাপাড়ায় দুই বোন করবী ও বছর পঁয়ষট্টির পূরবীদেবীর সঙ্গে থাকতেন নীলমণিবাবু। কেউই বিয়ে করেননি। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তিন ভাইবোনই উচ্চশিক্ষিত। নীলমণিবাবু এক সময় বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে অ্যানাটমির অধ্যাপক ছিলেন। নীলমণিবাবু জানান, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোলমালের জেরে ২০০৬ সাল নাগাদ তাঁর চাকরি যায়। ফলে পেনশন এবং অবসরকালীন ভাতা কিছুই পাননি তিনি। ফলে সংসারে আর্থিক অনটন ছিল।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকদিন আগে করবীদেবীকে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করান নীলমণিবাবু। গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে সেখানে মারা যান করবীদেবী। পরদিন সকালে দেহ নিয়ে নীলমণিবাবু বাড়িতে এলেও দেহের সৎকার করেননি। প্রতিবেশীরা দেহ সৎকার করার কথা বললে তিনি জানান, টাকা নেই। প্রতিবেশীরা জানান, তাঁরা সৎকারের জন্য চাঁদা তুলে দিতে চাইলে বৃদ্ধ জানান, তিনি কারও সাহায্য নেবেন না। শুধু তাই নয়, জোর করে যদি কেউ দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেন বলে প্রতিবেশীদের অভিযোগ। তিনদিন ধরে ওই ভাবেই পড়েছিল মৃতদেহ। দেহে পচন ধরায় দুর্গন্ধ ছড়ালে প্রতিবেশীরা শেষ পর্যন্ত বুধবার সকালে উলুবেড়িয়া থানায় খবর দেন।
পুলিশ এলেও প্রথমে তাদের বাড়িতে ঢুকতে বাধা দেন নীলমণিবাবু। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বুঝিয়ে পুলিশ বাড়িতে ঢোকে। পুলিশ জানায়, দোতলার ঘরের মেঝেতে চাদর পেতে শোয়ানো ছিল করবীদেবীর দেহ। পাশের ঘরে ছিলেন আর এক বোন পূরবীদেবী। যদিও করবীদেবীর দেহ তিনদিন ধরে আটকে রাখা নিয়ে তিনি কিছু বলতে চাননি। এর পর স্থানীয় একটি ক্লাবের সহায়তায় দেহ উদ্ধার করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বোনের মুখাগ্নি করেন নীলমণিবাবুই। সৎকারের খরচ দেয় পুলিশই।
আরও পড়ুন: আয়ে নজর, সাগরে বছরভর পর্যটক চান মমতা
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, আর্থিক কষ্টে ছিল পরিবারটি। নীলমণিবাবুর উপার্জন বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু কারও কাছে কোনও সাহায্যও চাইতেন না তিনি। কিছু জমিজমা থাকলেও সে সব বিক্রি করে কোনওমতে তাঁদের চলছিল। টাকার অভাবে না সারানোর ফলে দোতলা বাড়িটিও ভগ্নপ্রায়। পাড়ায় তিন ভাইবোন কারও সঙ্গে মিশতেন না। এ দিন পুলিশ যখন সৎকারের জন্য করবীদেবীর দেহ নিয়ে যাচ্ছিল তখনও নীলমণিবাবুকে বলতে শোনা যায় ‘টাকার অভাবেই দেহ সৎকার করতে পারছিলাম না। বোনের দেহের সৎকার করতে কারও কাছে হাত পাততে চাইনি।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy