Advertisement
১১ মে ২০২৪
নোটের গুঁতো

উধাও পুজোর আড্ডা, কাটছাঁট কার্তিক বাজেটেও

মণ্ডপ শিল্পীর সাফ জবাব, ‘নগদ নারায়ণ’ পেমেন্ট ছাড়া নেবেন না। তবে ওই নগদে ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট নৈব ন‌ৈব চ! এই বাতিল নোটের গুঁতোয় অনুষ্ঠান কাটছাঁট করতে হয়েছে পুজো উদ্যোক্তাদের। নোটের আকালে মণ্ডপে আড্ডা ছেড়ে কেউ দাঁড়াচ্ছেন এটিএমের সামনে, কেউ ব্যাঙ্কের লাইনে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘জরুরি’ বৈঠক ডেকেছে বিভিন্ন কমিটি।

কামারপাড়া মিলন সমিতির মণ্ডপ। — নিজস্ব চিত্র

কামারপাড়া মিলন সমিতির মণ্ডপ। — নিজস্ব চিত্র

প্রকাশ পাল ও সুশান্ত সরকার
বাঁশবেড়িয়া শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০২:২৫
Share: Save:

মণ্ডপ শিল্পীর সাফ জবাব, ‘নগদ নারায়ণ’ পেমেন্ট ছাড়া নেবেন না। তবে ওই নগদে ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট নৈব ন‌ৈব চ!

এই বাতিল নোটের গুঁতোয় অনুষ্ঠান কাটছাঁট করতে হয়েছে পুজো উদ্যোক্তাদের। নোটের আকালে মণ্ডপে আড্ডা ছেড়ে কেউ দাঁড়াচ্ছেন এটিএমের সামনে, কেউ ব্যাঙ্কের লাইনে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘জরুরি’ বৈঠক ডেকেছে বিভিন্ন কমিটি।

এই ছবি বাঁশবেড়িয়ার কার্তিক পুজোয়। কার্তিক পুজোর পাশাপাশি বহু দেবদেবীর পুজো হয় এখানে। সব জায়গাতেই কমবেশি একই পরিস্থিতি। কারও বাজেট ১ লক্ষ টাকা। কারও বাজেট ৪-৫ লক্ষ ছাড়িয়েছে। কারও বাজেট ঘোরাফেরা করছে ১০-১২ লক্ষের আশপাশে। কিন্তু বাতিল নোট নিয়ে উদ্ভুত পরিস্থিতি সকলের কপালেই ভাঁজ ফেলেছে।

খামারপাড়া মিলন সমিতি রাধাকৃষ্ণের পুজো করে। মঙ্গলবার এখানে জনা পনেরো অনাথ শিশুকে খাওয়ানো, পোশাক এবং খেলনা দেওয়া হয়। পূর্ব নির্ধারিত এই কর্মসূচি অবশ্য ভেস্তে যেতে বসেছিল।

কিন্তু কেন? পোশাক বিক্রেতার ৫০০ বা হাজার টাকার নোটে ‘অরুচি’। অগত্যা নিজেদের পকেট থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে জামাকাপড় কে‌না গিয়েছে। পুজো কমিটির সম্পাদক বিপ্লব সেনচৌধুরী বলেন‌, ‘‘এটিএম থেকে তুলে নয়-দশ জন মিলে ২০০০ টাকা করে দিতে হয়েছে।’’ কমিটির অন্য এক কর্তা বলেন, ‘‘বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি বটে, কিন্তু সংসার চালানো মুশকিল হবে। এখন তো ব্যাঙ্কে লাইন দেওয়ার সময় নেই।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এ বার হয়তো গিন্নির মুখঝামটা খেতে হবে!’’

লেবুতলা কার্তিক পুজো কমিটি এলাকার ছেলেপুলে বা মহিলাদের নিয়ে নানা ধরণের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ছোটখাট হরেক রকমের উপহার থাকে। কিন্তু টাকার অভাবে অত পুরস্কার কেনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন উদ্যোক্তারা। ফল? অনুষ্ঠান রীতিমতো কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এ কথা শুনেই ছোটদের মুখ ভার! ওই পুজো কমিটির লোকেরা জানান, মণ্ডপশিল্পী চেক নেবেন বলেছেন, সেটা বাঁচোয়া। তবে মণ্ডপ তৈরি যাঁরা করছেন, তাঁরা খাওয়াদাওয়া বাবদ ১০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। তাঁরা ৫০০ বা হাজার টাকা নেবেন না। ১০০ বা ৫০ টাকার নোট মিলিয়ে ৬ হাজার টাকা দেওয়া গিয়েছে। পুজোর উদ্যোক্তাদের আশঙ্কা, যা পরিস্থিতি, তাতে হয়তো ভাসানের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাও নমো নমো করে সারতে হবে। কেন না, ট্রাক ভাড়া, আলো, ট্রাকের উপর আলো লাগানোর কাঠামো তৈরি, ব্যান্ড বা অন্যদের জন্য টিফিন, জল এত সব আসবে কোথা থেকে? কেউ তো আর ৫০০ বা হাজার টাকার নোট নিতে চাইবেন না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার জন্য আজ, বুধবার পুজোর দিন বৈঠক ডাকা হয়েছে।

মিলনপল্লী সর্বজনীন নটরাজ পুজো কমিটির সম্পাদক বিদ্যুৎ দে বলেন, ‘‘৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোটের জন্য মহাবিপদে পড়ে গিয়েছি। আমাদের বাজেট ছিল প্রায় ১২ লক্ষ টাকা। মণ্ডপ করেছেন মেদিনীপুরের শিল্পীরা। কিন্তু তাঁরা ৫০০ বা হাজার টাকার নোট নিতে চাইছেন‌ না। পরিস্থিতি বুঝে বাজেট অনেকটা কমাতে হয়েছে।’’ ধুমো কার্তিক পুজো কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় অগ্রিম দিয়ে রেখেছে‌ন। বিসর্জনের দিন পুরো টাকা মেটানোর কথা। সে দিন কী ভাবে সবাইকে সন্তুষ্ট করা যাবে, তা ভেবেই আকুল তাঁরা। কুণ্ডুপল্লি নটরাজ পুজো কমিটির সম্পাদক শঙ্কর শেঠের কথায়, ‘‘আমাদের বাজেট ৭ লক্ষ। সমস্যার সমাধান করতে বাটা দিয়ে বেশ কিছু টাকা ভাঙানো হয়েছে। তাতে অবশ্য বাজেট বাড়বে।’’

বলাকার সম্পাদক চন্দ্রনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘চাঁদা তুলতে পারছি না। কেউ খুচরো দিচ্ছেন না। আমরাও ৫০০ বা হাজার টাকা নিয়ে বিড়ম্বনা বাড়াতে চাইছি না। নিলে খুচরো দেব কী করে? একই কারণে সদস্য চাঁদাও জমা পড়েছে কম। ক্লাবের অ্যাকাউন্টে যে টুকু টাকা আছে, তা দিয়ে সব দিক সামলানো যাবে না। বাধ্য হয়ে বাজেট কমাতে হচ্ছে।’’ পুজোর কল্যাণে অবশ্য ২০০ টাকা বাড়তি লাভ হয়েছে বলে ওই পুজো কমিটির এক সদস্য জানালেন। কেমন করে? একগাল হেঁসে ওই যুবক বললেন, ‘‘পাড়ার এক কাকু গত বার ৩০০ টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগে বাড়ি বাড়ি বিল দিতে যাওয়ার সময় উনি জানিয়ে দেন, টাকার অঙ্ক বাড়াবেন না। সেই তিনিই সোমবার নিজে এসে ৫০০ টাকা হাতে ধরিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে না!’’

রেনেসাঁ কার্তিক পুজো কমিটির সদস্যরা জানান, গত বছর ১১০ জন দুঃস্থ মান‌ুষকে তাঁরা বস্ত্রদান করেছিলেন। এ বার টাকার সমস্যার জন্য মাত্র ৫০ জনকে পোশাক দেওয়া হচ্ছে। কমিটির সম্পাদক সৌমেন কুণ্ডু বলেন, ‘‘পুজোর বাজেট ছিল প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। সেই বাজেট কমানো হয়েছে। পেমেন্ট করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। মণ্ডপশিল্পীরা তমলুক থেকে এসেছেন। ওঁরা ৫০০ বা হাজার টাকার নোট নিতে চাইছেন না।’’ মণ্ডপশিল্পী নারায়ণ নেতা বলেন, ‘‘শ্রমিকেরা ওই নোট নিচ্ছেন না। আমরাও তাই নিতে পারছি না। আর এখানে বাজার করা থেকে অন্যান্য জরুরি জিনিস কেনা দুষ্কর হচ্ছে। এখানে তো আমাদের কারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kartik Puja Bansberia Demonetization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE