পরিবর্তন: মেশিনেই চলছে শাড়ি তৈরি। নিজস্ব চিত্র
একটা সময় এসেছিল, যখন বাঙালি মেয়ে মুখ ফিরিয়ে ছিল শাড়ি থেকে। সে দিন গিয়েছে। সারা বিশ্বে শাড়ি এখন আবার সৌন্দর্যের অন্যতম সংজ্ঞা হয়ে উঠেছে। আর সেখানে বাংলার তাঁতের কদর আলাদা।
কিন্তু সে রূপকথা টানছে না তাঁতি বাড়ির নতুন প্রজন্মকে। শিল্প হারাচ্ছে তার শিল্পীকে, শুধু মজুরির সঙ্কটে।
তাই হাসি নেই বেগমপুরে। তাঁতিদের মহল্লার সুদিন গিয়েছে। সামনেই বাঙালির উৎসবের মরসুম। কিন্তু মন ভাল নেই তাঁতিদের। এক সময় তাঁতিদের সমবায়গুলো রমরম করে চলত। সমবায় থেকে সুতো পেতেন তাঁতিরা। বুনে দিতেন শাড়ি, পেতেন মজুরি। তারপর সে শাড়ি বাজারে বিক্রি করত সমবায়ই।
একাধিক সরকারি সংস্থা সেই সব সমবায় থেকে শাড়ি কিনে নিয়ে যেত। ফলে বাজারের অপেক্ষায় তাঁতিদের বসে থাকতে হত না। কিন্তু এখন সেই সমবায়গুলিই মুখ থুবড়ে পড়ছে। বেগমপুরে একমাত্র খড়সরাই-মধ্যমপাড়া সমবায় সমিতিই চলছে লাভের পথ ধরে। বাকি ৮-১০টি সমবায় রয়ে গিয়েছে শুধু খাতায়-কলমে, অভিযোগ তাঁতিদের।
কেন এই পরিস্থিতি?
প্রবীণ তাঁতি কাশীনাথ সেন জানালেন, ‘‘নতুন প্রজন্ম তাঁত বোনায় উৎসাহ পাচ্ছে না। মজুরি এত কম যে, নতুন ছেলেরা এই কাজে আর একেবারে আসতেই চাইছে না।”
কাশীনাথবাবু ও তাঁর প্রজন্মের অনেকের গলায় ঝরে পড়ে আক্ষেপ, “আমরা তো আর এত লেখা পড়া জানতাম না। বাপ-ঠাকুরদার তাঁতই ছিল ধ্যানজ্ঞান।” নতুন প্রজন্মের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে চাকরির সন্ধানে উৎসাহ দেখাচ্ছে বেশি। অভাবের সংসারে কোনওভাবেই ফিরতে চান না তাঁরা।
বেগমপুরের তাঁতিরা দেখালেন মজুরির হিসাব। মহাজন সাধারণ শাড়ি প্রতি ১৫০ টাকা মজুরি দেন। সারা সপ্তাহে বড়জোর পাঁচটা শাড়ি বুনতে পারেন একজন তাঁতি। অর্থাৎ সারা সপ্তাহে একজন তাঁতির উপার্জন দাঁড়ায় সাড়ে সাতশো টাকায়। কাশীনাথবাবু বলেন, “এখন বাজারের যা পরিস্থিতি তাতে আমার ছেলে বা নাতিকে ওই টাকায় সংসার চালাতে বলি কোন মুখে!”
বেগমপুরে এখনও তাঁত সম্বল করেই দিন গুজরান করেন নবীন সেন। তিনি বলেন, “১৪ বছর তাঁতের কাজ করছি। সাধারণ ভাবে আমরা যে কাজ করি তাকে কাটাই নকশার কাজ বলে। এই কাজে মজুরি কম। বড় জোর দেড়শো টাকা। তবে ডিজাইনের কাজ করলে বা ১০০ কাউন্টের সুতোর শাড়ির কাজ করলে
৩০০-৫৫০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়।” সেই শাড়িও যে সপ্তাহে খুব বেশি চারটে বোনা যায়। ফলে সংসার চালানোর জন্য রোজগার অপ্রতুল।
তবে আশার কথা সামান্য হলেও শুনিয়েছেন নবীন সেন। বেগমপুরে এখন একটা ‘ক্লাস্টার’ গড়া হয়েছে। তাঁতিদের কিছুটা হলেও সুবিধা হয়েছে। ক্লাস্টার থেকেই ওরাই সুতো দিচ্ছে। শাড়িও নিচ্ছে। ক্লাস্টারে গিয়ে শাড়ি বুনে আসছেন তাঁতিরা। বেগমপুরের তাঁতি মহল্লায় এখনও পাঁচ শো থেকে ছয়শো ঘর তাঁতি রয়েছেন।
আগে মাকুর খটাখট শব্দে কান পাতা দায় হত। এখন আর তা হয় না। তবু বেঁচে আছে শাড়ি—বারো হাতের রূপকথা।
সুনামই সহায় বেগমপুরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy