ঠকিয়ে কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে সহজে যাতে তফসিলি উপজাতির জমি কেউ না কিনে নিতে পারে সে জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে চলেছে রাজ্য সরকার। এ বার তফসিলি উপজাতিভুক্ত ব্যক্তির রেকর্ড বা পরচাতে তার উল্লেখ রাখা হবে ১৪সি। যাতে সরকারি অনুমতি ছাড়া তফসিলি উপজাতিভুক্ত ব্যক্তি জমি রেজিস্ট্রি না করতে পারেন।
পরচায় ১৪সি লেখার কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও জলপাইগুড়ি তিন জেলায় পাইলট হিসাবে এই কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে রাজ্যের সর্বত্রই এই পদ্ধতি মেনে কাজ হবে। পশ্চিম মেদিনীপুরের ভূমি ভূমি সংস্কার আধিকারিক অরিন্দম দত্ত বলেন, “যাতে ঠকিয়ে কেউ তপসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের জমি কিনতে না পারেন তাই এ পদক্ষেপ।”
এ পদক্ষেপ সাধারণ আদিবাসীদের সম্পত্তি অনেকটাই সুরক্ষিত করবে বলে আশাবাদী মাঝি মাডওয়া জুয়ান গাঁওতার সাধারণ সম্পাদক প্রবীর মুর্ম্মু। তাঁর কথায়, “অনেক সময় গরিব আদিবাসীদের ভুল বুঝিয়ে কম দামে জমি কিনে নিয়ে তাঁদের ভূমিহীন করে দেওয়া হয়। অসাধু পথে তা নিজেদের নামেও করে নেন অনেকে। কড়াকড়ি হলে কিছুটা তো কাজে লাগবেই।” ১৪সি ধারায় তপসিলি উপজাতির জমি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে কিনতে হলে সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হয়। আগেও এই নিয়ম ছিল। তবু একই নিয়ম পালনে পরচায় ১৪সি ধারা উল্লেখ করার প্রয়োজনটা কোথায়?
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, নিয়মের ফাঁক গলে অনেকেই বেনিয়ম করে নানা কৌশলে। অবশ্যই এক্ষেত্রে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের পাশাপাশি বেনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন কিছু প্রশাসনিক আধিকারিকও। তপসিলি উপজাতির মধ্যেও এমন অনেক পদবি রয়েছে যা দেখে বোঝা কঠিন তিনি উপজাতি কিনা। মাণ্ডি, মুর্ম্মু, সোরেন, হেমব্রমের মতো পদবি দেখে সহজে তপসিলি উপজাতি বলে ধরা গেলে লোধা সম্প্রদায়ের নায়েক, মল্লিকদের ক্ষেত্রে তা বোঝা দুষ্কর। তা ছাড়াও আগে রেজিস্ট্রি করার ক্ষেত্রে তেমন কোনও বিধি নিষেধ ছিল না। ফলে জমির দলিল হয়ে যেত সহজেই। পরে নামপত্তনের সময় সত্যিটা ধরা পড়ত।
তখনই দেখা হত, জমি কেনাবেচার জন্য জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরের অনুমতি রয়েছে কি না। এক্ষেত্রেও সুযোগ থাকত কারচুপির। অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরে এক শ্রেণির কর্মী ও আধিকারিকও অসাধু কাজে জড়িয়ে গিয়ে সেই অনুমতির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আবার শুরুতেও তা না করতে পারলে রেজিস্ট্রি হয়ে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট আদিবাসীকে সেই জমি থেকে সহজেই উত্খাত করে দেওয়া যেত। জমিহারা হতে হত গরিব আদিবাসীদের। বহু ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে, নানা ভাবে প্রলুব্ধ করে আদিবাসীদের জমি নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ক্ষেত্রে বেঙ্গল এনার্জি নামের ইস্পাত কারখানা হোক বা ঝাড়গ্রামের এমপিএস গ্রিনারি কিংবা চন্দ্রকোনা রোডে প্রয়াগ ফিল্ম সিটির মতো বড় বড় ক্ষেত্রে এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ, প্রথমে নামপত্তনে আটকে দিলেও প্রশাসনের একাংশের মদতে নামপত্তনে অসুবিধে হয় না। মিলত অনুমতিও। বড় বড় ব্যবসায়ীরা অসাধু উপায়েই এই কাজ করে নিতেন অবলীলায়।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রায় ১৮ শতাংশ তপসিলি উপজাতির বাস। তাঁদের কার কত পরিমাণ জমি রয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রত্যেকের জমির পরচাতে লেখা হবে ১৪সি। যে সব পদবি দেখে সহজেই উপজাতি সম্প্রদায়ের বলে বোঝা যাবে সেগুলি সহজেই করে দেওয়া যায়। বাকি ক্ষেত্রে এলাকায় গিয়ে নথির পাশাপাশি জমির অবস্থান দেখে তা লিপিবদ্ধ করা হবে। এই কাজ শেষ হয়ে হওয়ার পর জমি কেনাবেচা করলে নতুন পরচায় ১৪সি লেখা হবে। যদি কেউ জমি কেনাবেচা না করেন তাঁদেরও আবেদন জানানো হবে। তাঁরা চাইলে নতুন পড়চা নিতে পারবেন। এই নথি পাঠিয়ে দেওয়া হবে রেজিস্ট্রেশন দফতরে। যাতে তাঁরা রেজিস্ট্রির সময় সরকারি অনুমতি দেখে নেন। শুধু এটাই নয়, এ বার থেকে জমির দলিলে মালিক পুরুষ না মহিলা তারও উল্লেখ করা হবে। চুড়ামড়ি, মনসা-র মতো কিছু নাম পুরুষ বা মহিলার থাকে। এক্ষেত্রে নাম নিয়ে জালিয়াতি করার সুযোগও থেকে যায়। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে জমি নিয়ে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। মানুষ বাড়ছে কিন্তু জমি বাড়ছে না। জমির দামও বেড়ে চলেছে। মুনাফার লোভে বেআইনি কাজও ঘটে চলেছে। তা রুখতেই এই পদক্ষেপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy