তিরুপতি বালাজি মন্দিরের আদলে চলছে মণ্ডপ তৈরির কাজ। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।
প্রায় সাড়ে চার দশক আগের কথা। তখন মাও-জে-দঙের বাণী ধার করে ‘বন্ধুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ আওড়ানোর পাশাপাশি ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা’র তত্ত্ব প্রচার করতেন নকশালপন্থীরা। মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত এলাকা আয়েসবাগ এ রকম কোনও তত্ত্ব না আওড়েই গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার আয়োজন করেছে। আর হাতিয়ার? বন্ধুকের নল নয়, আয়েসবাগের মৃন্ময়ী দেবীপ্রতিমা।
মুর্শিদাবাদ থানার নতুনগ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় ‘আয়েসবাগ বারোয়ারি দুর্গোৎসব কমিটি’র অবস্থান। এই পুজো কমিটির অভিনব প্রচারে মুখ ঢেকেছে বহরমপুর, লালবাগ, ইসলামপুর, ডোমকল, ফরাক্কা, মালদহ, সিউড়ি মায় শিয়ালদহের মতো স্টেশনেরও। এই শহরগুলিতে ঝোলানো হয়েছে ১৫ ফুট বাই ২০ ফুটের শতাধিক ঢাউস হোর্ডিং। তাতে লেখা রয়েছে ‘মুর্শিদাবাদ স্টেশন থেকে আধ ঘণ্টায় তিরুপতি/ এ কেমন কেরামতি?’
সতিই তো, মুর্শিদাবাদ স্টেশন থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতির বালাজি মন্দির পৌঁছতে কয়েক দিনের ধাক্কা। সেই দূরত্ব আয়েসবাগ মাত্র আধ ঘণ্টায় নামিয়ে আনল কোন ম্যাজিকে?
রাজ্য সড়ক ধরে বহরমপুর থেকে লালবাগের দিকে রওনা দিলে রৌশনবাগ বিএসএফ ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছনোর আগেই পড়বে আয়েসবাগ বাসস্টপ। ৩০ ফুট থেকে ৪৫ ফুট উচ্চতার ২৬টি আলোকতোরণের ঝরণা ধারায় ভাসতে ভাসতে আয়েসবাগ বাসস্টপ থেকে পূবমুখী পথে ঢুকলেই নজরে আসবে তিরুপতির বালাজি মন্দির। স্বর্ণমন্দিরে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিরুপতির আদলে দু’টি দুধ সাদা বিশাল প্রবেশদ্বার। সেই প্রবেশদ্বার দু’টিও যেন মন্দির। স্বর্ণমন্দিরের পশ্চিম দিকের মণ্ডপে রয়েছে সপরিবার দেবীদুর্গা। মৃন্ময়ী ওই মূর্তি গড়া হয়েছে তিরুপতির বালাজি মন্দিরের লক্ষ্মী-নারায়ণের আদলে। স্বর্ণমন্দিরের পিছনে রয়েছে বিঘা দু’য়েকের পুকুর। সেই পুকুরে রয়েছে আরও একটি মন্দির আর কিছু মডেল। বালাজি মন্দিরে প্রবেশের আগে পুকুরের ওই মন্দিরে যজ্ঞ ও মানতের ক্ষৌরকর্ম সারতে হয়। জলা ও ডাঙা মিলিয়ে বিঘা পাঁচেক এলাকা জুড়ে ৬০-৭০ ফুট উচ্চতার মণ্ডপ সজ্জার ওই এলাহি আয়োজন। এ ভাবেই আয়েসবাগে উঠে এসেছে তিরুপতি।
৫৭ তম বছরের পুজো হলেও বিগত ৪ বছর ধরে আয়েসবাগের মতো এলাকা বহরমপুরের মতো শহরের তাবড় তাবড় পুজো কমিটির কর্তাদের গুনে গুনে গোল দিয়েছে। আয়োজন বলছে, পঞ্চমবারও ব্যতিক্রম হবে না। এ বারের তিরুপতির বালাজি মন্দিরের মতো গত চার বছরে আয়েসবাগ পুজো কমিটির কর্তারা মণ্ডপে তুলে এনেছিলেন তারাপীঠ, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, বুদ্ধগয়া, কাশীর বৃন্দাবন ধাম। সেই পরম্পরা বজায় রাখতে মাস তিনেক আগে চার মণ্ডপ শিল্পীকে নিয়ে কমিটির দুই কর্তা গিয়েছিলেন তিরুপতি। ওই শিল্পী দলের প্রধান দীপক কর্মকার বলেন, ‘‘অবিকল আদল আনতে আমরা টিমের সদস্যেরা বালাজি মন্দিরের খুঁটিনাটি স্টাডি করেছি। তারপর তিন মাস ধরে চলছে এই নির্মাণ কাজ।’’
বাজেট কত? জনশ্রুতি বলছে, কোটি টাকা! পুজো কমিটির সম্পাদক নেপাল দাস অবশ্য বলেন, ‘‘পুজো শেষ না হলে বলা সম্ভব নয়।’’ তিনি জানান, গত বছর বৃন্দাবন ধাম করতে লেগেছিল ৫০ লক্ষ টাকা। এ বছর বেশি খরচ হবে, তা অস্বীকার করছেন না তিনি। এত টাকার ধাক্কা সামলাবেন কী করে? নেপালবাবু বলেন, ‘‘একটি লোহার রড তৈরি করে এমন একটি শিল্পপতি গোষ্ঠী দিচ্ছে ২০ লক্ষ টাকা। পুজো কমিটির এক কর্তার রয়েছে পরিবহণ ব্যবসা। পুজোয় আলোর যাবতীয় খরচ তিনি বহণ করবেন। এ রকম আরও দান রয়েছে।’’
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, আয়েসবাগের পুজো দেখতে গত বছরগুলিতে দর্শনার্থীদের লাইন কম করেও চার কিলোমিটার ছাড়িয়েছে। ওই দীর্ঘ প্রতীক্ষা এড়াতে এ বার নতুন ব্যবস্থা নিয়েছে পুজো কমিটি। লাইনে না দাঁড়িয়ে সরাসরি ‘বালাজি’ দর্শন করতে হলে ২০০ টাকা দিয়ে কিনতে হবে বিশেষ প্রবেশপত্র। সম্পাদক বলেন, ‘‘ওই প্রবেশপত্রে একই পরিবারের ৪-৫ জন দেবীদর্শন করতে পারেন। এ রকম ১০ হাজার প্রবেশপত্র বিক্রি করা হবে। ইতিমধ্যে ৫ হাজার প্রবেশপত্র বিক্রি হয়েছে।’’ বহরমপুরের এক অভিজাত বস্ত্র ব্যবসায়ী তাঁর বিশেষ ক্রেতাদের উপহার দেওয়ার জন্য ৩ হাজার প্রবেশপত্র কিনেছেন।
এ ছাড়াও রয়েছে ‘প্রসাদ-ব্যবসা’। কলকাতা থেকে আসছেন ৫ জন ময়রা। তাঁরা তৈরি করবেন কেসর দেওয়া উপাদেয় লাড্ডু। বড় সাইজের দু’টি লাড্ডুর একটি প্যাকেটের দাম পড়বে ৫০ টাকা। ছোট সাইজের দু’টি লাড্ডুর একটি প্যাকেটের দাম পড়বে ৩০ টাকা। সম্পাদক জানান, ১০০ জন মহিলা স্বেচ্ছাসেবিকা ওই লাড্ডু-প্রসাদ বিক্রি করবেন। দু’টো কাউন্টার থাকবে। একটি থেকে কুপন কিনতে হবে। অন্যটি থেকে লাড্ডুর প্যাকেট সংগ্রহ করা হবে।
১৭ অক্টোবর, চতুর্থীতে তারাপীঠের স্বামীজি ওই পুজোর উদ্বোধন করবেন। বিসর্জন ২৫ অক্টোবর। এলাহি পুজোর আয়োজন সামল দিতে ৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও প্রতিদিন থাকবেন ৬০ জন বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষী। সঙ্গে ১৫০ জনের পুলিশ বাহিনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy