লাঠি খেলার মহড়া। মঙ্গলবার, চাঁদপুরে। নিজস্ব চিত্র।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই ভীমপুরের চাঁদপুরে আদিবাসী পাড়ায় ব্যস্ততা তুঙ্গে। সেখানে গত অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে শুরু হওয়া টুসু পরব শেষ হতে চলেছে ১৪ তারিখ পৌষ সংক্রান্তিতে। সেই উপলক্ষে ১২ ডিসেম্বর থেকে তিন দিন ব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন চাঁদপুর আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দারা।
আসাননগর বাজার থেকে উত্তর দিকে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে চাঁদপুর গ্রাম। মঙ্গলবার সকালে চাঁদপুর আদিবাসী পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের মাঝে মাধবী তলায় মেঘাই সর্দারের সমাধিস্থলের সামনে পিংলা থেকে আসা বাপী চিত্রকর, টগর চিত্রকরেরা গ্রামের মানুষকে আদিবাসী পটচিত্রের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। খানিক দূরে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা লাঠিয়াল প্রকাশ বিত্তারের কাছে লাঠিখেলার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে।
সমাধিক্ষেত্রের পিছন দিকে বিজয় সর্দারের বাড়ির বারান্দায় পাড়ার মেয়ে-বৌয়েরা বসে। মাটির পাত্রে গোবরের তৈরি টুসুর অবয়ব বানিয়ে চালের গুঁড়ো, সিঁদুর ও কাজলের টিপ দিয়ে টুসু পেতেছেন। এক মাস ধরে রোজ সন্ধ্যায় সেখানে পাড়ার মহিলারা টুসুকে ঘিরে বসে গ্রামের খেত থেকে তুলে আনা সরষে বা মটর জাতীয় ফুল দিয়ে টুসুকে সাজান। সঙ্গে গান ধরেন— ‘টুসুমনি মা গো, আলতা পরা পা গো’ কিংবা ‘সাজ দিলাম, সন্ধ্যা দিলাম, স্বর্গে দিলাম বাতি গো’।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, ১২ ও ১৩ এই দু’দিন লাঠিখেলা ও পটচিত্রের কর্মশালার শেষে, ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে আর ১৪ ডিসেম্বর সারা রাত নদিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আদিবাসী শিল্পীর দল ঝুমুর নাচ পরিবেশন করবেন সেখানে। ১৪ তারিখ বিকেলে মাধবী তলায় ছোটখাট মেলাও বসবে। মেলায় আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী মাংসের পিঠে-সহ আরও নানান ধরনের পিঠেপুলি মিলবে। এর পর ১৫ ডিসেম্বর সকালে কলিঙ্গ নদীতে টুসুকে ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে শেষ হবে চাঁদপুরের টুসু পরব।
জানা গেল, প্রতি বছর এই পরব অনুষ্ঠিত হলেও লাঠিখেলা ও পটচিত্রের কর্মশালা এই প্রথম। নদিয়া জেলার আদিবাসী সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকা মানসী দাসের উদ্দ্যোগেই এ বছর চাঁদপুরে এই কর্মশালার আয়োজন।
মানসী বলেন, ‘‘লাঠিখেলা এই গ্রামের ঐতিহ্য ছিল এক সময়। ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। হারানো ঐতিহ্যকে ফেরানোর চেষ্টাতেই এই কর্মশালার আয়োজন।’’
জনশ্রুতি, গ্র্যান্ড সাহেব নামে এক নীলকর সাহেব পুরুলিয়া, বাঁকুড়া অঞ্চল থেকে মুন্ডা সম্প্রদায়ের কিছু আদিবাসী মানুষকে চাঁদপুরের গোলদার কুঠিতে নিয়ে আসেন লেঠেল হিসাবে। মূলত, নীল চাষে অনিচ্ছুক চাষিদের নীল চাষে বাধ্য করাই ছিল এই লেঠেলদের কাজ। এঁরাই চাঁদপুর আদিবাসী গ্রামের আদি বাসিন্দা।
‘‘নীলকর সাহেবেরা তাঁদের নিয়ে এলেও পরবর্তীতে নীল বিদ্রোহের সময়ে এই গ্রামেরই মেঘাই সর্দারের নেতৃত্বে আদিবাসীরা নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।’’ বলেন এক প্রবীণ।
অন্য দিকে, লাঠিখেলার কর্মশালা দেখে আপ্লুত গ্রামের সত্তর বছরের প্রবীণ মানিক সর্দার। তিনি বলেন, ‘‘বাপ-ঠাকুরদার কাছে লাঠি খেলা রপ্ত করেছিলাম। সে সময় গ্রামে লাঠি খেলার কয়েকটা দলও ছিল। কিন্তু আফশোস, আমার কাছ থেকে এ খেলা আর কেউ শিখল না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy