খুন তো এই তল্লাটে অনেকই হয়। কিন্তু মেধাবী ও নম্র স্বভাবের সন্তানকে হারানোর ব্যথা তাতে মুছে যাচ্ছে না। রিজুয়ানুর রহমকে খুনের প্রতিবাদে সজল নয়নেই ক্ষোভ জানাল ডোমকল।
বুধবার সকাল থেকে অবরোধ, মৌন মিছিল, প্রতিবাদ মিছিল আর মোমবাতি মিছিলে সামিল হল ছাত্র-ছাত্রী থেকে আম জনতা। মোমবাতি মিছিল হবে জিয়াগঞ্জ শহরেও। এ ছাড়াও এদিন সকাল থেকে সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গিয়েছে প্রতিবাদের। সব মিলিয়ে এ দিন শোকের ছায়ার পাশাপাশি প্রতিবাদেও মুখর ছিল ডোমকল। এ দিন সকাল ৯টা থেকে ডোমকল পুরাতন বিডিও মোড়ে বহরমপুর করিমপুর রাজ্য সড়কে দেহ রেখে চলে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অবরোধ। প্রায় ৪ ঘণ্টা অবরোধে যাত্রীরা আটকে পড়লেও বিরক্তি নয়, সেখানে বসে বা বাস থেকে নেমও কেউ কেউ সামিল হয়েছে প্রতিবাদে।
খুন, খুনের বদলা খুনই দেখতে অভ্যস্ত ডোমকল। খুব সামান্য কারণেও এখানে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কখনও মুরগি বা ডিমের অধিকার নিয়েও খুন হয়েছেন মানুষ। আবার ঘটনা ঘটলেই তাতে জুড়ে গিয়েছে রাজনীতির রং। কিন্তু বুধবার সকাল থেকে ডোমকল দেখল এক অন্য প্রতিবাদ। রিজয়ানুরের খুনের প্রতিবাদে প্রথমে এদিন সকালে ডোমকল পুরাতন বিডিও মোড়ে রাজ্য সড়কে দেহ রেখে চলে প্রতিবাদ বিক্ষোভ। পরে ডোমকল ভবতারণ স্কুলের পক্ষ থেকে শুরু হয় একটি মৌন মিছিল, তা ছাড়াও ডোমকলের আইন মহাবিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিবাদে মুখর হয় ছাত্রছাত্রীরা। শেষে সন্ধ্যায় আম জনতার পক্ষ থেকে মোমবাতি মিছিল ডোমকল পুরাতন বিডিও মোড় থেকে। পুরাতন বিডিও মোড়ের বাসিন্দা মিজানুর রহমানের কথায়, ‘‘ডোমকল অনেক খুনের সাক্ষী এটা ঠিক, কিন্তু এমন ফুলের মতো একটা ছাত্রকে এ ভাবে হত্যাটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। ফলে এ দিনের প্রতিবাদ মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষোভ থেকে হয়েছে। অভিযুক্তরা শাস্তি না পেলে যেন স্বস্তি নেই ডোমকলের।’’
ডোমকল ভবতারণ হাইস্কুলের প্রাক্তন ওই ছাত্রের খুনের ঘটনায় হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী এদিন দুপুরে পথে নামেন। আইন পড়ুয়ারা বিচারের দাবি তুলে মুখর হন। টানা রোদকে উপেক্ষা করেও গোটা ডোমকল বাজার ঘুরে প্রতিবাদে সরব সকলে। ভবতারণ স্কুলের প্রধান শিক্ষক তপনকুমার সামন্ত বলেন, ‘‘সকালে খবরের কাগজে ছবি ও খবর দেখেই চমকে গিয়েছি। আমি ওকে ভাল করেই চিনতাম। ভদ্র ও শান্ত ছেলেটিকে এ ভাবে খুন কেন করা হল সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা এদিন ঘটনার প্রতিবাদে সকলে একটি মৌন মিছিল করেছি। আমরাও চাই অভিযুক্ত কঠোর শাস্তি হোক।’’ রিজের কাকা আশিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘মঙ্গলবার থেকে অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে ঘুরছি। তার মাঝেও মানুষের এই প্রতিবাদ আমাদের শক্তি যোগাচ্ছে, মনে হচ্ছে প্রশাসন ঘটনাকে যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক মানুষ গর্জে উঠবেই। সাধারণ মানুষ ছাত্র ছাত্রীদের প্রতিবাদ বিফলে যাবে না।’’
এখানেই শেষ নয়, ডোমকলের আম জনতার হুমকি পুলিশ ও প্রশাসন এই ঘটনায় অভিযুক্তদের আড়াল করার চেষ্টা করলে এই আন্দোলন বৃহত্তর হবে বলেও ডাক দেওয়া হয়েছে। এ দিন অবরোধে আটকে থাকা বাস থেকে নেমে হোগলবাড়িয়াড় নিমাই মণ্ডল রিজয়ানুরে দেহটি এক ঝলক দেখে নিয়ে বলেন, ‘‘অনেক সময় সামান্য কারণে কথায় কথায় অবরোধ হয়, কিন্তু আজকের এই অবরোধে সামিল হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। খুনের অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির দাবি করছি।’’
ঈদ উপলক্ষে আর ক’টা দিন পরেই ঘরে ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু তার অনেক আগেই ঘরে ফিরল রিজ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দেহ ডোমকলের বাড়িতে পৌঁছতেই সাধারণ মানুষ ভেঙে পড়ে তার বাড়ির সামনে। একবার তাকে দেখার জন্য সকলেই উঁকি মেরেছেন পরিচিত মুখটার দিকে, তবে ফেরার সময় চোখে জল সকলের। দেহের পাশে দাড়িয়ে বাবার আক্ষেপ, ‘‘হাতটা মুচড়ে ভেঙে দিয়েছে ওরা। সেটা ভেঙেও যদি ওকে বাঁচিয়ে রাখত তাহলে আমাদের বুকটা অন্তত খালি হত না।’’
সম্ভ্রান্ত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী পরিবার রিজদের। ব্যবসা আর সন্তানদের লেখাপড়ার টানেই ডোমকলের দক্ষিণ নগর গ্রাম থেকে ডোমকলে ঘাঁটি গাড়ে বিশ্বাস পরিবার। কোনও দিনও কোনও গণ্ডগোলে জড়ানোর ঘটনা মনে নেই তাঁদের বা ডোমকলের মানুষের। ফলে তাঁদের পরিবারের সন্তানকে এ ভাবে খুন হতে হবে ভাবতেও পারছে না গোটা পরিবার। তা ছাড়া রিজের আচরণের সঙ্গেও মিলছে না ঘটনা। ফলে গোটা পরিবার কোনও ভাবেই মানতে পারছে না এই মৃত্যু।
এ দিন দুপুরে তাদের গ্রামের বাড়ি দক্ষিণ নগরে কবর দেওয়া হয় দেহ। তবে প্রতিবাদ থেমে নেই, সন্ধ্যায় মোমবাতি মিছিল ছাড়াও সোসাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ছে। একটাই শব্দ, শাস্তি চাই, বিচার চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy