Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সাঁঝ-বাদলে ৭

বাগান ফুঁড়ে গন্ধটা যেন তেড়ে এল

শ্রাবনের কালো মেঘ বিকেল ফুরনোর আগেই আঁধার বয়ে এনেছে। গ্রামের এক প্রান্তে পঞ্চায়েত অফিসে ছোট ঘরটায় প্রবল বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে জনাপাঁচেক মানুষ। তাঁর মধ্যে আছেন মুখুজ্জে কাকাও। এক সময় সদর আদালতে মুহুরি নবীন মুখোপাধ্যায়, এলাকার স্বঘোষিত অভিভাবক।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০৯:১০
Share: Save:

অফিস থেকে বেরোনর ঠিক মুখেই মুষলধারে বৃষ্টি।

শ্রাবনের কালো মেঘ বিকেল ফুরনোর আগেই আঁধার বয়ে এনেছে। গ্রামের এক প্রান্তে পঞ্চায়েত অফিসে ছোট ঘরটায় প্রবল বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে জনাপাঁচেক মানুষ। তাঁর মধ্যে আছেন মুখুজ্জে কাকাও। এক সময় সদর আদালতে মুহুরি নবীন মুখোপাধ্যায়, এলাকার স্বঘোষিত অভিভাবক। নবীনকাকা নানা কাজে প্রায়ই আসতেন পঞ্চায়েতে। সে দিনও এসেছিলেন গ্রামতুতো এক আত্মীয়কে নিয়ে। গল্পের অফুরান ভাঁড়ার তাঁর।

প্রবল বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ আটকে থেকে পঞ্চায়েতের কর্মী অলকেশের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সে বেরোবে। অলকেশের নাছোড় ভাব দেখে নবীন কাকা বলে উঠলেন “এই বাদলায় তুমি সুলন্টুর আমবাগান পার হতে পারবে তো?” বলেই নবীনকাকা কেমন যেন শিউরে উঠলেন। অলকেশ হাত নেড়ে কিছু একটা বলতেই রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠে কাকা বলেন “সব কিছু ওভাবে উড়িয়ে দিও না।”

ততক্ষণে গল্পের গন্ধ পেয়ে বাকিরা কাকাকে চেপে ধরেছে। তখনই প্রচণ্ড শব্দে খুব কাছেই একটা বাজ পড়ল। মুহূর্তে গোটা ঘর অন্ধকারে ভরে গেল। বিদ্যুৎও সেই সুযোগে উধাও হয়ে গেল।

ড্রয়ার হাতড়ে একটা মোমবাতি অলকেশই খুঁজে পেতে বের করে জ্বালিয়ে টেবিলের মাঝখানে রাখল। বাইরের দমকা হাওয়ায় মোমের কাঁপা কাঁপা আলোয় খেই ধরলেন নবীনকাকা।

নবদ্বীপের পাশেই পূর্বস্থলীতে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। এমনিতে ট্রেন পথেই যাওয়া যায়। কিন্তু নবদ্বীপের দক্ষিণদিক দিয়ে আড়াআড়ি চলে গেছে কালনা-কাটোয়া রোড, সেখান সুলন্টুর গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা চট জলদি পূর্বস্থলী যাওয়া যেত। আমবাগানের ভিতর দিয়ে কাঁচা রাস্তা। এক বর্ষার রাতে ওই পথে ফিরতে গিয়ে মারাত্মক অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। সে কথা মনে হলেই এখনও গা ছমছম করে তাঁর, বলেই মুখটা মুছে নিলেন তিনি।

অনেকদিন রোগভোগের পর নবদ্বীপ ষ্টেট জেনারেল হাসপাতালে সে দিন ভোরে মারা গিয়েছেন শাশুড়ি মা। তিনি বলেন, ‘‘আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন। বিরাট কিছু বয়সও হয়নি। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা।’’ দাহকর্ম মিটে যাওয়ার পরে বাড়ি পরে স্নান সেরে ফের যখন রওনা দিলেন শ্বশুর বাড়ি তখন বিকেল। সেখানে শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারে কথা বলে বের হতে একটু দেরিই হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার জন্য শেষ পর্যন্ত যখন বেরলেন তখন বেশ রাত। গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। কাকা বলে চলেছেন, ‘‘আমার বন্ধু বেঁকে বসল। ‘এই রাতে সুলন্টু দিয়ে যাব না।’’

কিন্তু জেদ চেপে গেল তাঁর। ওই পথেই যেতে হবে। তাই হল। পাকা রাস্তা থেকে সুলন্টুর কাঁচা রাস্তা ধরতেই কেমন যেন বোঁটকা গন্ধ এসে নাকে লাগল। অনেকটা মরা পোড়ার মতো। কাকা বলছেন, ‘‘ভাবলাম সকালে শ্মশানের গন্ধটা নাকে লেগে আছে হয়ত। কিন্তু সাইকেল যত আমবাগানের দিকে এগোয় মড়া পোড়ানোর সেই গন্ধ ততই বাড়তে থাকে যেন। একটা সময়ে মনে হচ্ছিল গন্ধটা যেন আমাদের তাড়া করে আসছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। পিছনে আমার বন্ধু আমাকে শুধু বলে চলেছে ‘নবা আরও জোরে চালা। আরও জোরে।’ কিন্তু বর্ষাকালের কাঁচারাস্তায় কি আর জোরে সাইকেল চালানো যায়? একসময় মনে হল সাইকেলটা কে যেন পিছন দিকে টানছে।’’

গন্ধটা তখন এতই উৎকট আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। কানের কাছে একটা ফিসফিস শব্দ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। আতঙ্কে চোখ বুজে অন্ধের মতো চালাচ্ছি। কতক্ষণ চলেছিলাম মনে নেই।

হঠাৎ চারদিক ঝলসে একটা প্রকান্ড বাজ পড়ল। দুজনেই ভয়ে চিৎকার করে সাইকেল থেকে ছিটকে পড়লাম। হুঁশ ফিরতে দেখলাম বড় রাস্তার ধারে উপুড় হয়ে পরে আছি। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। তবে, সেই গন্ধটা হারিয়ে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE