Advertisement
০৭ মে ২০২৪

কেউ দেখে না, ভোটে অরুচি সাগরিকার

ভোটের মুখে নবদ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভিক্ষা মেলে না বললেই চলে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ১০:১২
Share: Save:

ভিক্ষায় পাওয়া খুচরো পয়সাগুলো বার-বার গুনছিলেন সাগরিকা হালদার। চারটে দু টাকা আর পাঁচটা এক টাকার কয়েন। সব মিলিয়ে তেরো টাকা। এর মধ্যে কে আবার একটা এক টাকার ছোট কয়েন দিয়েছেন বাটিতে। গোনার সময় নজর পড়তেই শাপশাপান্ত শুরু— ‘‘ভিখারিকে অচল পয়সা দিলে পাপে পচে মরবি। অমন ভিক্ষে দিস কেন?’’ ব্যাপার দেখে নিজের বাটির পয়সাগুলো ভাল করে পরখ করে দেখে নেন পাশে বসা ময়না দাসী, অনিতা সরকার, প্রবাসী শীলেরা।

নবদ্বীপের গঙ্গার ধারে রাধারানী মন্দিরের প্রবেশ পথের ডান দিকের কোণে বসে ভিক্ষা করেই ওঁদের দিন গুজরান। কিন্তু ভোটের মুখে নবদ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। ভিক্ষা মেলে না বললেই চলে। তাই ভোটের কথা তুলতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন যেন। গলাটা বেশ চড়িয়ে সাগরিকা হালদার বলেন, “আমাদের আবার ভোট! পেটে খাবার জোটাতেই হিমশিম হাল। ভিক্ষে জুটলে খাই না জুটলে নয়। ভোট নিয়ে আমাদের কোনও মাথা ব্যাথা নেই। বরং এই ভোট-ভোট করে ভিক্ষা পাওয়া মাথায় উঠেছে।” তপ্ত দুপুরে সুনসান নাটমন্দিরের দেওয়ালে যেন ধাক্কা মারছিল সেই ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বর। বাকিরা মুখে কিছু না-বললেও চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁদের সমর্থনের কথা।

এক সময়ে নবদ্বীপের এক নামকরা চাদর তৈরির কারখানায় ব্লক প্রিন্টিংয়ের কাজ করতেন পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাগরিকা। স্বামী তাঁত বুনতেন। ২০০২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে সব ওলটপালট। ডান হাত মারত্মক ভাবে ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দিন রাত এক করে খেটে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বসত ভিটের কিছু অংশ বেচে নিজের হাতের চিকিৎসা করতেই মেয়ে-জামাইরা ভয়ানক চটে যান। এরই ফল যে, সত্তর বছরের সাগরিকা দেবীকে ভিক্ষাপাত্র হাতে মন্দিরের দরজায় বসতে হয়েছে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। ঝাঁঝালো গলাটা যেন নিভে যায়। নোংরা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে অসহায়ের মতো অ্যালুমিনিয়মের লম্বাটে একটা টিফিন কৌটো তুলে ধরেন। তার তলানিতে পরে আছে সামান্য লালচে ভাত। অন্য এক মন্দিরে হরিনাম করে জুটেছে। এখন এই মন্দিরে ভিক্ষায় যা মিলবে তাই দিয়ে আনাজপাতি কিনে তবে দুপুরের খাওয়া হবে। একটু সামলে নিয়ে ফের জ্বলে ওঠেন। ক্ষোভ উগড়ে দেন— “ভোটার কার্ড আছে আমার। কিন্তু ভোট দিই না, দেব না। কেন দেব? কোন সরকার আমাদের জন্য কী করেছে? মাথার উপর ছাদ, রেশন, বার্ধক্য ভাতা কিছুই তো আমি পাইনি। উল্টে তা চাইতে গিয়ে গালিগালাজ শুনেছি। ঘেন্না ধরে গিয়েছে ভোটে।’’

এক সময়ে কীর্তন গাইতেন ময়না দাসী আর মাধাই দাস। এক দিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান মাধাই। কিছুদিন পর স্ট্রোকে শরীরের এক দিক পক্ষাঘাতে অবশ হয়ে যায় ময়নার। ঠাঁই হয় মন্দিরের দরজায়। নাকে রসকলি, গলায় তুলসির মালা। মুখে অমলিন হাসি। বলেন, “অসুখ হওয়ার পর আর ভোট দিইনি। শরীর খারাপের সময় কেউ তো দেখেনি আমায়। পথে নামতে হয়েছে। যে মন্দিরে ভিক্ষা করি সেখানকার কর্তৃপক্ষই যা করার করেছেন। আমাদের ভোটের কোনও দাম নেই। দিয়ে লাভও নেই।’’ নবদ্বীপ জুড়ে এমন ভিক্ষাজীবী প্রচুর আছেন। এঁদের অনেকে গঙ্গা পেরিয়ে ওঁরা আসেন প্রতিদিন সকালে। দুপুর গড়ালে ফিরে যান। অনেকে আবার রাত পর্যন্ত থাকেন। এলাকার ভিখারিদের বেশিরভাগেরই ভোটার কার্ড আছে। তবে ভোট দেওয়া নিয়ে আগ্রহ নেই। কারণ, দীর্ঘদিন সর্বস্তরের বঞ্চনা, অবহেলা সইতে সইতে এঁরা বীতশ্রদ্ধ।

তিপান্নো বছরের ছেলে চোখের সামনে রক্তবমি করে মারা গিয়েছিল। সেই থেকে আর ঘরে মন টেঁকেনি রিষড়ার মালতী দত্তের। আগেই মারা গিয়েছিলেন স্বামী। ছেলের শোকে সব ছেড়ে নবদ্বীপে এসে এখন ভিক্ষাবৃত্তি করেন তিনি।

ভোটের কথায় বললেন, ‘‘আমার ভোট তো রিষড়ায়। যাবো কিনা ঠিক নেই। আর কেনই বা ভোট দেব? আমার ছেলের যখন অসুখ বাড়ছিল তখন কোনও দলের সাহায্য তো পাইনি। পেলে আমার কোলটা এ ভাবে শূন্য হতো না। ভাল লাগে না ভোট-টোট।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE