প্রতীকী ছবি।
লোকসভা ভোটের দিন তিনেক আগের কথা। কল্যাণী ব্লক তৃণমূলের এক নেতা সন্ধ্যায় বসে রয়েছেন তাঁর ঘরে। একে-একে কর্মীরা আসছেন। বলছেন— ‘‘দাদা, বিজেপি বাড়ছে। লুকিয়ে অনেকে মোদীর সভায় গিয়েছিল। ঠাকুরনগরে যোগী আদিত্যনাথের সভাতেও ঘুরে এসেছে।’’
বহু কর্মীর কাছ থেকে একই কথা শুনতে-শুনতে ক্লান্ত নেতা এ বার বলেই ফেললেন, ‘‘কী করা যাবে? দোষ তো আমাদের। রাজ্য সরকারের জনমোহিনী কর্মসূচির অভাব নেই। কিন্তু প্রবল দুর্নীতি হচ্ছে। আগে আমাদের যে নেতা বাজারে গেলে বাসি পুঁটির দর করতেন, এখন দরাদরি না করে বড় ইলিশটা-চিতলটা কিনছেন। সাইকেলে চেপে ঘোরা নেতারা দামি মোটরবাইকে, এমনকি চারচাকাতেও ঘুরছেন। মানুষ সব দেখছে।’’
ঘনিষ্ঠ মহলে তৃণমূলের প্রায় কোনও নেতাই অস্বীকার করছেন না, নেতাদের একাংশের দুর্নীতির জেরে বিজেপির অনুকূলে প্রবল চোরাস্রোত বইছে। সেই স্রোত গিয়ে শেষমেশ কোথায় আছড়ে পড়েছে, তা কেউই হলফ করে বলতে পারছেন না। কৃষ্ণনগর বা রানাঘাট কেন্দ্র তো বটেই, সদ্য হয়ে যাওয়া বনগাঁ আসনের ভোটেও কল্যাণী শহর ও গ্রামীণ এলাকায় দুর্নীতি ও নেতাদের আর্থিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধিই ছিল ইস্যু।
প্রচার যত তুঙ্গে উঠেছে, ভোটের মাহেন্দ্রক্ষণ যত কাছে এগিয়ে এসেছে, রাস্তাঘাট-চায়ের দোকানের আড্ডায় কল্যাণীর শিক্ষিত সচেতন ভোটারেরা আক্ষেপ করেছেন অর্ধশিক্ষিত কিছু নেতার ঠাটবাট নিয়ে। তাঁদের মনে হয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের ওই সব নেতারা কল্যাণীকে সোনার ডিম দেওয়া হাঁস ঠাউরেছেন। যেখানে টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলেই তা তালুবন্দি করা যায়। এই নেতাদের শায়েস্তা করতেও বিজেপির দিকে ঢলে গিয়েছেন অনেকে।
কল্যাণীতে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকায় তৈরি হচ্ছে এইমস। ঈশ্বর গুপ্ত সেতুর পাশে কয়েকশো কোটি টাকা খরচে তৈরি হচ্ছে নতুন অত্যাধুনিক সেতু। জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়-সহ উচ্চশিক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই। কল্যাণী পুরসভার বার্ষিক বাজেটও বেশ মোটা অঙ্কের। সব মিলিয়ে বছরে বিরাট টাকার কাজ হয়। শত-শত কোটি টাকার ইমারতি দ্রব্যের জোগান যায়। তবে সেই কাঁচামালের জোগান দিতে গেলে রাজনৈতিক পরিচয় লাগে। এক সময় এইমসে বালি-পাথর-সিমেন্ট দেওয়ার বরাত নিয়ে তো ভাল রকম ঝামেলাও হয়েছিল।
দিন দুয়েক আগেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী নিজের অফিসে বসে বাঁকা হেসে বলছিলেন, ‘‘তৃণমূলের কিছু নেতা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। তবে তাঁদের বিনিয়োগ কম। কোনও-কোনও ক্ষেত্রে শূন্য বললেই চলে। কিন্তু পুরো কাজ শেষ হওয়ার আগেই লাভের অংশ দিয়ে দিতে হয়।’’
যাঁরা এখনও ক্ষমতা এবং লাভের গোলাঘরে পৌঁছতে পারেননি, সেই বিরোধী নেতারাই প্রত্যাশিত ভাবে সবচেয়ে সরব। বিজেপির কল্যাণী শহর মণ্ডলের সহ-সভাপতি তথা মতুয়া সেনার নদিয়া জেলার সভাপতি তারকনাথ সরকারের অভিযোগ, ‘‘যে কাউন্সিলর এক সময়ে ভ্যান নিয়ে হোসিয়ারির ব্যবসা করতেন, তাঁর ঠাটবাট এখন শহরের চর্চার বিষয়। যে কাউন্সিলর চোলাই বা দেশি খেতেন, তাঁরা এখন বিলিতি না হলে চলে না!’’ কল্যাণীর গ্রামীণ এলাকার বিজেপি যুবনেতা তুষার পালের দাবি, ‘‘সামান্য মাছ ব্যবসায়ী এখন তৃণমূল করে কোটিপতি।’’
মুশকিল হল, ভোটারদের একটা বড় অংশই এই সব অভিযোগ বিশ্বাস করছেন। কল্যাণী শহর তৃণমূলের সভাপতি অরূপ মুখোপাধ্যায় অবশ্য পাল্টা দাবি করছেন, ‘‘কেউ যদি ব্যবসা করে সম্পত্তি বাড়ান, সেটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করা ঠিক নয়। আমরা অষ্টপ্রহর মানুষের সঙ্গে থাকি। মানুষ আমাদের সঙ্গেই রয়েছে।’’ তাঁর দাবি, কল্যাণী বিধানসভা থেকে ৩০ হাজারের বেশি লিড পাবেন বনগাঁর তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর।
সাধারণ মানুষের একটা অংশের ক্ষোভ যে রয়েছে, সেই সত্যিটা কিন্তু ভোটের অঙ্কের সঙ্গে পাল্টাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy