বাজারে যাওয়ার আগে। — নিজস্ব চিত্র।
একটু পরিকল্পনাই ফারাক গড়ে দিল। বছর কয়েক ধরে ফরাক্কার চাষিরা লিচু চাষ করে সে ভাবে লাভবান হচ্ছিলেন না। ফলন মার খাচ্ছিল। এই অবস্থায় ফি বছর মাথায় হাত দেওয়াই যেন দস্তুর হয়ে পড়ে চাষিদের। কিন্তু এ বছর উদ্যান পালন দফতরের পরামর্শে পরিকল্পিত চাষে ফলন বেড়েছে কয়েকগুন। চওড়া হয়েছে চাষির হাসি।
এবার প্রতিটি গাছেই অন্যান্য বারের চেয়ে দেড় থেকে দু হাজার করে বাড়তি ফল পেয়ে খুশি বাগান মালিরাও। পরের বছরের জন্য তারা এখন থেকেই বাগান পরিচর্যা শুরু করেছেন।
এই সাফল্যের পিছনের ইতিহাসটা যে খুব আহামরি তা নয়। এতদিন কোনও পরিকল্পনা, পরিচর্যা ছাড়াই লিচু চাষ হত। বিঘার পর বিঘা বাগানে লোকসান ঠেকানো যেত না। এবারের ছবিটাও একই রকম হতে পারত। কিন্তু এবার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এল জেলা উদ্যান পালন বিভাগ। কারণ প্রতি বছর জেলায় ধারাবাহিকভাবে লিচুর ফলন কমে যাওয়া কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল তাঁদেরও।
মুর্শিদাবাদে প্রায় ৩৪০০ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হয়। তার মধ্যে ২৭৫০ হেক্টরই, অর্থাৎ ৮০ শতাংশই রয়েছে জঙ্গিপুর মহকুমায়। গত বছর জেলায় প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন লিচু উৎপাদন হয়েছিল। তার মধ্যে জঙ্গিপুর ৩২ হাজার মেট্রিকটন লিচু উৎপাদন হয়েছিল। এবারে সেই ফলন বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। কিন্তু উৎপাদন বাড়ল কেমন করে? মুর্শিদাবাদ জেলার উদ্যানপালন বিভাগের উদ্যানবিদ শুভদীপ নাথ জানিয়েছেন, লিচু ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞানভিত্তিক চাষের তোয়াক্কাই করতেন না। বছরের পর বছর একই পদ্ধতিতে চাষের ফলে ফলন কমছিল। সেই জন্যই এবার তাঁদের উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। তাও মাত্র ছ’মাস আগে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আরও আগে থেকে তাঁদের বিজ্ঞানভিত্তিক চাষের উপযোগীতা বোঝাতে পারলে ফলন আরও বাড়ানো সম্ভব হত।
একসময় রঘুনাথগঞ্জ শহরে ব্যবসা করতেন নজরুল ইসলাম। কিন্তু লোকসানের ধাক্কায় দোকান বিক্রি করে দিতে হয়। সেই টাকাতেই ইলিয়াসপুরে নিজের বাড়ির পাশেই জমি কিনে তৈরি করেন লিচু বাগান। আগে বাগানের পরিচর্যা থেকে ফলের বিক্রি সবই নিজের হাতে করতেন। কিন্তু লাভের হার কমতে থাকায় বছর দুই থেকে পুরো বাগানই লিজে দেন।
তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পোকার আক্রমণ, সব মিলিয়ে কোনও গাছ থেকেই তিন-চার হাজারের বেশি লিচু পাওয়া যেত না। গতবছরের ফলনে ক্ষতি হয়েছে খুব বেশি।”
কানুপুরের আসরাফুল শেখ। ২১ বিঘা লিচু বাগানের মালিক এখন তিনি। বাগানে রয়েছে দেশি ও মুম্বই লিচু ছাড়াও চিনা, কাফেরি, বেদানা ও আতা প্রজাতির লিচুও। ২৫ বছরের এই বাগানে তিন শ’রও বেশি লিচু গাছ রয়েছে। গাছে সাধারণ ভাবে গড়ে ছ’ হাজার করে লিচুর ফলন হয়। এবারে তা গড়ে আট হাজারে দাঁড়িয়েছে।
তিনি জানিয়েছেন, বাগানের পরিচর্যা যা করা হয়, তা নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। ফলে, লিচুতে চুষি পোকা থেকে নানা ধরণের রোগ পোকার আক্রমণ ঘটে। ফলন মার খায়। বাজারের দোকানদারের পরামর্শ মতই কীটনাশক কিনে এনে ব্যবহার করি । শুধু ফলনই নয়, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে এবার এবার লিচু আকারেও বড় হয়েছে।
অন্যান্য বছর সংখ্যায় একশো লিচুর ওজন যেখানে থাকে বড় জোড় আড়াই কিলোগ্রাম। এবারে তা তিন কিলোরও বেশি। ফলে লিচুর সাইজে বাড়বাড়ন্তের জন্য বাড়তি দামও পাচ্ছেন লিচু বাগানের মালিকেরা। বাগান মালিকরা জানিয়েছেন, এতদিন গতানুগতিক ভাবে লিচু বাগান করেছেন। কিন্তু, কিছুতেই ফলন বাড়ানো যাচ্ছিল না। তাই এবার গাছে মুকুল আসার আগেই তাঁরা উদ্যান পালন দফতরের প্রশিক্ষণ শিবিরে যোগ দেন। প্রতিটি গাছের চারিদিকে কয়েক হাত দূরে খোল, পটাশ, ডিএপি সার মিশিয়ে মাটিতে গর্ত করে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
পাশাপাশি লিচু গাছে মুকুল আসার আগেই গাছগুলিতে নিম মিশ্রিত জৈব কীটনাশকের পরিমাণ বাড়িয়ে রাসায়নিক কীটনাশক অল্প পরিমানে মিশিয়ে স্প্রে করা হয়। পরে আরও একবার একই ভাবে ওই মিশ্রণ আবার স্প্রে করা হয়। এর ফলে চুষি পোকার আক্রমণ থেকে লিচু রক্ষা করা গিয়েছে। ভাল দামও মিলেছে।
জঙ্গিপুরে যেহেতু লিচু ভাল অর্থকরী ফসল তাই এবারে এখন থেকেই আগামী বছরে লিচুর ফলন বাড়াতে প্রশিক্ষণ শুরু করছে জেলার উদ্যান পালন দফতর। শুভজিৎ নাথ জানিয়েছেন, এক বঠর আগের থেকে যদি পরিকল্পনামাফিক এগনো যায়, তাহলে ফলন আরও বেশি বাড়ানো সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy